Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইসলাম

মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

ডিসেম্বর ১০, ২০২০, ০৬:৩০ পিএম


 ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইসলাম

ইনসাফ অর্থ সমান দুই ভাগ করা, বেশি বা কম না করা। আল্লাহ তাআলার একটি নাম হলো ‘আদল’ অর্থাৎ ন্যায়বান, ন্যায়পরায়ণ। আদালত অর্থ ন্যায়ের স্থান। মুমিন জীবনের পূর্ণতার জন্য তাকওয়া বিশেষ শর্ত; তাকওয়ার পরিচায়ক হলো ন্যায়বিচার। ইসলাম একটি শান্তিপ্রিয় ধর্ম এবং এর শিক্ষা অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। ইসলামের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সমাজ ও দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নবীর (আ.) আগমন ঘটেছে, তাদের প্রত্যেককে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ যেসব দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সকল নবীই (আ.) দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন।

সমাজে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও পরস্পর নানান বিষয়ে প্রতিযোগীতা অতীতে ছিলো, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। জমি-জমা, আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার পালাবদল কিংবা সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে কেন্দ্র করে মানুষ পারস্পরিক বিবাদ-বিতর্কে লিপ্ত হয়। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাজ এবং পরিবারে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান

আছে বলে কোরআনে এসব বিষয় ফায়সালা করার দিক নির্দেশনা এসেছে। সমাজে চলমান এই সমস্যাগুলো ন্যায়ের সাথে ফায়সালা করার ক্ষেত্রে মোমিনের দায়িত্ব রয়েছে। যারা ন্যায়-নিষ্ঠতার সাথে সমাজে ফায়সালা করেন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে খুব ভালোবাসেন। এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা দুটো দলের মাঝে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে ফায়সালা করে দেবে এবং তোমরা ন্যায় বিচার করবে; নিশ্চয়ই আল্লাহপাক ন্যায় বিচারকদের ভালবাসেন’ (সূরা হুজরাত:৯)।

ইসলামী শাসনে সকল নাগরিকের ন্যায্য বিচার পাবার অধিকার রয়েছে। খুনের বদলে খুন, কানের বদলে কান, নাকের বদলে নাক। আর ব্যভিচারের শাস্তি
আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর মনে হলেও সমাজে স্থায়ী শান্তি আনার জন্য সুষ্ঠু বিচারের বিকল্প নেই। ইনসাফ এবং সাম্যনীতি ইসলামী বিচার ববস্থার অন্যতম মূল বৈশিষ্ট।
মহান আলাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায় পরায়ণতার সাথে করবে” (সূরা নিসা, ৫৮)।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, তোমরা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা করো নিশ্চয়- আল্লাহ তায়ালা তার সম্যক খবর রাখেন’ (সুরা মায়িদা, ৮)।

উক্ত আয়াতের নিরিখে হজরত ওমর ফারুক (রা.) কাযী শুরায়হ-এর নামে একটি আদেশ লিখে পাঠিয়েছিলেন। ওমর (রা.) লিখেন ‘বিচার সভায় দরকষাকষি করবে না, কারো সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে না। কোন ধরনের ক্রয়-বিক্রয় করবে না এবং রাগান্বিত অবস্থায় তুমি দুই ব্যক্তির মধ্যে বিচারের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করবে না’ (তানতাবী, ৩০৭)।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ রয়েছে ‘আর মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের মাঝে তোমরা মীমাংসা করে দিও। এরপর তাদের মাঝে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করলে যে দল সীমালঙ্ঘন করে, তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। এরপর তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে এলে তোমরা উভয়ের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে মীমাংসা করে দিও এবং সুবিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন’ (সুরা হুজুরাত: ৯)।

হাদীস শরীফে এসছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) এরশাদ করেন, সাত শ্রেণীর লোকদের আল্লাহ সেই কঠিন দিনে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তারা হচ্ছেন: ১. ন্যায়বিচারক, ২. ঐ যুবক যে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত তথা তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্যের মধ্যে যৌবনকাল অতিবাহিত করেছে, ৩. ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে জড়ানো, ৪. ঐ দু’ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসে; আল্লাহর জন্যই তারা মিলিত হয় এবং আল্লাহর জন্যেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ৫. ঐ লোক যাকে অভিজাত বংশীয় কোনো সুন্দরী রমণী কুকর্মের জন্যে আহবান করে, জবাবে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি, ৬. ঐ লোক যে গোপনে দান করে, এমনকি তার ডান হাত কি দান করল বাম হাত তা টেরও পায় না, ৭. ঐ লোক যে একাকী গোপনে আল্লাহকে স্মরণ করে দুচোখের অশ্রু ঝরায়, (বুখারী:৬৬০), অন্য বর্ণনায় এসেছে, নিশ্চয়ই যারা ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করে আল্লাহর নিকট তারা নূরের আসন গ্রহণ করবে, (নাসায়ী:৫৩৭৯)।

ইসলামে ন্যায়বিচারের শিক্ষা এমন এক অনন্য শিক্ষা, যা ন্যায়পরায়ণ প্রত্যেক অমুসলিমও শুনে প্রশংসা না করে পারে না। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করাই
মহানবীর (সা.) আগমনের উদ্দেশ্য এবং তিনি নিজ আমল দ্বারা সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে যেভাবে ইরশাদ করা হয়েছে ‘বল, আমার প্রভু আমাকে ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন’ (সুরা আরাফ: ২৯)।

আল্লাহ তায়ালার অনুপম শিক্ষা এবং ইসলামের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ তখনই সম্ভব হবে, যখন প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহপাকের প্রতিটি আদেশের ওপর আমল করবে। ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজেদের ঘর, সমাজ, আপন-পর, এমনকি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার সাথে ন্যায়সূলভ ব্যবহারের মাধ্যমেই আমরা মহানবীর (সা.) প্রকৃত অনুসারী বলে দাবি করতে পারি। এছাড়া কেবল মুখে শ্রেষ্ঠনবীর উম্মত হবার দাবির কোন মূল্য আল্লাহ পাকের কাছে নেই।

মহানবী (সা.) তা অক্ষরে অক্ষরে আমল করেছেন। একবার কুরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে রাসুল (সা.) তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসুলের (সা.) কাছে তার একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) সুপারিশ করেন। রাসুল (সা.) তাকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’

অতঃপর লোকজনকে আহবান করে মহানবী (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে, এ জন্য যে তাদের কোনো সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তার হাত কর্তন করে দিতাম’ (বুখারি ৩২১৬)। [চলবে]

লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী।

ibrahim010187@gmail.com

আমারসংবাদ/এআই