Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫,

ইসলামে সহনশীলতা ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত

অধ্যাপক মাওলানা সাইফ উদ্দিন আহমদ খন্দকার

এপ্রিল ২৪, ২০২১, ০৭:৪০ এএম


ইসলামে সহনশীলতা ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত

এক. ইসলাম অন্যের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়েছে। সমাজবদ্ধ জীবনে এই সহমর্মিতার অনেক প্রয়োজন। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ অন্যের সহমর্মিতা না পেলে তার জীবন বিষিয়ে ওঠে। বিভিন্ন সমস্যা ও বিপদগ্রস্ত মানুষ অন্যদের সহমর্মিতায় সান্ত্বনা খুঁজে পায়। মানবতার ধর্ম ইসলামে তাই সহমর্মিতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার খিয়ানত করবে না। তার বিষয়ে মিথ্যা বলবে না। তাকে অপমানিত হতে দেবে না। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের সম্মান, সম্পদ ও রক্ত হারাম। তাকওয়া (আল্লাহভীতি) হলো এখানে (অন্তরে) কোনো ব্যক্তির মন্দতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় দৃষ্টিতে দেখবে। (তিরমিজি)।

অন্য এক হাদিসে এসেছে : হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্য ইমারতের মতো। একটি ইট আরেকটিকে শক্তি জুগিয়ে থাকে। (তিরমিজি)। সামাজিক জীবনে এ শিক্ষার চর্চা এখন খুবই জরুরি। পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা ছাড়া কোনো সমাজের মানুষ সুখী-সমৃদ্ধ হতে পারে না। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানদের মাঝে যে পারস্পরিক  সহানুভূতি ও সহমর্মিতা ছিল বর্তমান মুসলিম সমাজে তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত। 

সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তারা তাদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তর কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। (সুরা হাশর, আয়াত ৯)। 

সাহাবা যুগের সোনালি ইতিহাসে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও সহানুভূতির যে দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তা বিশ্বদরবারে মুসলমানদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরে। দুঃখজনক সত্য যে, এখন আমরা দিন দিন খুবই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজনদের শোক-দুঃখে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা আমাদের মধ্যে লোপ পাচ্ছে। ফলে সমাজের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত লোকেরা নিতান্তই অসহায় হয়ে পড়ছে। কোনো মুসলিম সমাজের চিত্র আদৌ এমন হওয়া উচিত নয়। নবী ও সাহাবা যুগের চিত্রটা এমন ছিল না। এ অবস্থার অবসান হওয়া অতি জরুরি।  পবিত্র কোরআন-হাদিসের সহমর্মিতার শিক্ষায় আবার আমাদের দীক্ষিত হতে হবে। তবেই আমরা পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারব।

দুই. নিশ্চিতভাবেই, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর থেকে সহনশীলতার উত্তম কোন দৃষ্টান্ত হতে পারে না। রাসূল (সা.) যখন তার অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে মক্কায় দ্বীন প্রচার করছিলেন, তখন তাকে গালমন্দের জন্য তিনি কাউকে পাল্টা গালমন্দ করেননি। তায়েফে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে জর্জরিত করা হল, তথাপি তিনি কাউকে অভিশাপ দেননি। তার চোখের সামনে যখন মক্কাবাসীদের আরোপিত তিন বছরের অবরোধের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে তার চাচা ও স্ত্রী ইন্তেকাল করেন, তখনও তিনি অবরোধের জন্য দায়ি কাউকেই আঘাত করেননি।

পরবর্তীতে যখন তিনি বিজয়ী অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করেন, তিনি কারো কাছ থেকেই কোন প্রকার প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, এমনকি তার প্রিয়তম চাচার হত্যকারীকেও তিনি ক্ষমা করে দেন। অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সকল প্রকার অত্যাচার, আগ্রাসন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার জীবনের একনিষ্ঠ অধ্যয়নের মাধ্যমেই আমরা সহনশীলতা এবং এর সীমা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

তিন. বর্তমান পরিস্থিতিতে আলেম-ওলামা, মসজিদ, মাদরাসা ইসলামকি দল সমূহসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ অতিতের যে কোন সময়ের চাইতে অধিক বিপদ সংকল ও সংকটকালীন সময় অতিবাহিত করছে।  এর প্রেক্ষিতে আলেম-ওলামা, ইসলামপন্থী ও  ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ব্যক্তের ক্ষেত্রে  রাসূল (সা.) এর উদাহরণ স্মরণে রাখা উচিত। তার শিক্ষা অনুযায়ী সর্বোচ্ছ ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। একটি নতুন পৃথিবী গড়তে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে মনোযোগ নিবদ্ধ করে কাজ করতে হবে। তবেই তার শিক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে পারে পারস্পারিক সহাবস্থানের একটি সহনশীল নতুন বিশ্ব।

ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তি থেকে বৈশ্বিক জীবনে কখনো শান্তি আসেনি, সম্ভবও নয়। এটিই শাশ্বত সত্য। ইদানীং দেশে শাসকগোষ্ঠী ও জনগণের মাঝে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা চরমে পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে সহনশীলতা ও নিরবতা একটি উত্তম সমাধান এনে দিতে পারে। নীরবতা কখনো কখনো মারণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। নীরবতার প্রচ্ল আঘাতে সন্ত্রাস, চরমপন্থা, বর্ণবাদ ও সামপ্রদায়িকতাকে পরাভূত করতে পারে।

উগ্রবাদী আচরন, জুলুম নির্যাতন ও হিংসাত্ত্বক মানসিকতা পোষনকারীদের মনে রাখতে হবে, ভালোবাসার জাদুর কাঠিতেই কেবল দেশে শান্তি শৃংখলা ফিরে আসতে পারে। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে কেউ শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে পারেনি। এতে হানাহানি বেড়েছে বৈ কমেনি। তাই বিশ্বকে মানুষের বাসযোগ্য, শান্তিময় করতে সহাবস্থান ও সহনশীলতার বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, স্রষ্টার সৃষ্টি সব মানুষ সমান। সবাইকে শান্তিময় ও সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ গড়তে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যার যার অবস্থান ও ক্ষেত্রে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশ ও মানবতার কল্যাণ।

একে অন্যের স্থলে অজাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জনগণের নূন্যতম মৌলিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সীমিত পরিসরে হলেও গনতন্ত্রের চর্চা থাকতে হবে। অন্যথায় ভোক্তভুগিরা বেফরোয়া হয়ে উঠতে পারে।

(লেখক : অধ্যক্ষ, দারুল আজহার মডেল মাদরাসা)

আমারসংবাদ/এডি