Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর ৩৭ দফা ইশতেহার ঘোষণা

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

জানুয়ারি ২৩, ২০২১, ০১:৪৫ পিএম


চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর ৩৭ দফা ইশতেহার ঘোষণা

নগরীর জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনসহ আটটি প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ৩৭ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী। শনিবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে তিনি এ ইশতেহার ঘোষণা করেন।

জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, জলাবদ্ধতা ও জোয়ার জলের স্ফীতিরোধে জননেত্রী শেখ হাসিনা ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন। সিডিএ, ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনসহ কিছু সেবা সংস্থা এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ওয়াসায় যুক্ত হয়েছে পয়োঃনিষ্কাশন প্রকল্প। এসব মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অবশ্যই সর্বোচ্চ মনযোগ থাকবে।

যানজটকে নগরীর বড় সমস্যা উল্লেখ করে রেজাউল করিম বলেন, নগরীতে সড়ক সুবিধার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে আধুনিক সুবিধার যানবাহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি এবং রিক্শা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির মতো কায়িক শ্রমে চালিত বাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। তাছাড়া, সড়কের পাশে অপরিকল্পিতবাবে গড়ে ওঠা বহুতল দালানের অধিকাংশেরই নিজস্ব কোনো পার্কিং সুবিধা নেই। ফলে রাস্তায় যত্রতত্র গাড়ি রাখার কারণে মূল সড়কের অর্ধেকই বেদখলে চলে যায়। এতে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হয়। মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে নষ্ট হয় কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা ও অপচয় হয় বিপুল অর্থের। নগরীর এ জটিল সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে বসে যত দ্রুত সম্ভব সমাধানে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেব।

মেয়র নির্বাচিত হলে রেজাউল করিম চৌধুরী তার কর্মপরিকল্পনায় ১০০ দিনের অগ্রাধিকার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এতে তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নির্মূলে মহাপরিকল্পনা ও নগর উন্নয়নে ডেল্টা প্ল্যান সঠিকভাবে বাস্তবায়নে যাতে ন্যূনতম বাধা ও দীর্ঘসূত্রিতা না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থা ও সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সাথে বসে তা তদারকিতে অগ্রাধিকার দেব। বেদখলে যাওয়া খাল, নালা, নদী পুনরুদ্ধার ও পানি নিষ্কাশন উপযোগী করতে ১০০ দিনের মধ্যে সব ত্রুটি ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তা নির্মূলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করব।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলতেই হয়, বহরদার বাড়ি তথা বহদ্দার হাটের বাসিন্দা হিসাবে এই সংকটের সবচে বড় ভুক্তভোগী আমি নিজে ও স্থানীয় অসংখ্য নিরীহ মানুষ।

সড়ক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অঙ্গিকার ব্যক্ত করতে গিয়ে রেজাউল বলেন, নগরীতে সড়ক আছে জনসংখ্যার ঘনত্বের বিপরীতে মাত্র ১৫ শতাংশ। তাছাড়া একটি সড়ক, সেতু বা উড়াল সড়কের নির্দিষ্ট সহনক্ষমতা থাকে। কিন্তু এখানে কোন নিয়ম চলে না। দৈনিক ৫০ হাজার মেট্রিক টন সহনক্ষমতার একটি সড়কে চলে ১০ লাখ টন ওজনেরও বেশি গাড়ি। এতে সড়ক, সেতু, উড়াল সড়ক সব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, বাড়ে দুর্ঘটনা যানজট। ট্রাফিক বিভাগ, যানবাহন মালিক, বিআরটিএসহ সড়ক ব্যবহারকারী সবার সাথে বসে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবো। এমনিতেই বছরে দফায় দফায় জলজট ও জোয়ারের পানিতে নগরীর সীমিত সড়ক ব্যবস্থার প্রচুর ক্ষতি হয়। তার ওপর ফুটপাত, সড়ক, ওভারপাস সবখানেই আছে অনিয়ন্ত্রিত হকার, অবৈধ টেম্পো, সিএনজি, হিউম্যান হলার, ট্রাক স্ট্যান্ড। সমস্যাগুলো দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ঘটনা, পথচারীর দুর্ভোগ। গণসচেতনতা ছাড়া এককভাবে কারো পক্ষে এই অব্যবস্থাপনা সামাল দেয়া অসম্ভব। আধুনিক ডিজিটাল ট্রাফিক সিস্টেম ও মনিটরিং চালুর সাথে কঠোর সড়ক শৃঙ্খলাকে জোর দিতে হবে নগর রক্ষার স্বার্থে। পাশাপাশি ব্যস্ততম পয়েন্টগুলোতে নিরাপদ পথচারী পারাপারে আন্ডারপাস চালুর উদ্যোগ নেবো। আমাদের পরিবেশ উপযোগী ও উন্নত দেশের আদলে টেকসই সড়ক তৈরি করতে হবে।

মেয়র প্রার্থী রেজাউল বলেন, নালা নর্দমা, খাল-নদী দখল সমস্যা মহামারির মতই ব্যাপক। ফুটপাত থেকে শুরু করে নালা, নর্দমা, খাল, নদী সব দখল হয়ে যাচ্ছে। জমির দাম যত বাড়ে, দখল বাড়ে আরো দ্রুত। এর মাঝে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে সব নালা, নর্দমা, খাল, নদী উদ্ধার অভিযান চলছে। সবার সমন্বিত উদ্যোগে নাগরিকবান্ধব নগর গড়তে দ্রুত খাল, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হবে।

সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রায় ৭০ লাখ নাগরিকের মহানগরে প্রতিদিন হাজার হাজার টন বর্জ্য জমছে। সাবেক মেয়র ঘরে ঘরে বিনামূল্যে বিনবক্স সরবরাহ করে ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহ কর্মসূচি চালু করেছেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরো জোরালো ভূমিকা ও নজরদারি বাড়ানো হবে। নির্দিষ্ট বিনবক্স ছাড়া যত্রতত্র ময়লা ছুঁড়ে ফেলায় খাল-নালায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, ময়লা জমছে রাস্তাঘাটে। নাগরিক দায়িত্বশীলতা ফিরিয়ে এনে এই কুঅভ্যাস বন্ধ করতে হবে সবার সমন্বিত উদ্যোগে। বর্জ্য রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট গড়ে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তৈরি করা হবে।

তিনি বলেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন পণ্যের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রাকৃতিক পণ্য বিশেষ করে পাটজাত পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য যাতে নালা, নর্দমা, নদীতে জমে জলাবদ্ধতা ও দূষণ না ছড়ায়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, এনজিও পরিবেশবিদদের নিয়ে তদারকি কমিটি গড়া হবে। অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে আলাদা ডাম্পিং ইয়ার্ড করে রিসাইক্লিং প্ল্যান্টে রপ্তানি উপযোগী গৃহস্থালি সামগ্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে।

চট্টগ্রামকে পর্যটন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে রেজাউল করিম বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৈসর্গিক শোভা, ঐতিহ্য, জীবন ও জীববৈচিত্র, লোকজ শিল্প-সংস্কৃতি দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সোনার খনি। এমনকি চট্টগ্রাম নগরীও বিশ্ব পর্যটকদের জন্য চমৎকার এক জনপদ। পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভার থাকা সত্ত্বেও আমরা এগুলো ব্যবহার করতে পারছি না শুধুমাত্র উদ্যোগ ও অবকাঠামো গড়ে তোলায় ব্যর্থতার কারণে। অথচ স্বল্প বিনিয়োগ, পরিচর্যা ও উপযুক্ত প্রচারণার মাধ্যমে এ খাতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে পর্যটন খাত ও সৈকত পর্যটনে আধুনিক সুবিধা যোগ করে এই খাত থেকে নগর উন্নয়নে বাড়তি আয়ের ওপর জোর দেবো।

হোল্ডিং ট্যাক্স প্রশ্নে মেয়র প্রার্থী বলেন, নগরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়ক বাতিসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা দেয়া সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কাজ। আধুনিক চাহিদা ও বাস্তবতায় সিটি কর্পোরেশনকে আরো অনেক নাগরিক সেবার দায় টানতে হয়। সেবা খাতে আয়ের বড় উৎস হোল্ডিং ট্যাক্স বা গৃহকর। গৃহকর নিয়ে নানা সময়ে বিতর্ক তৈরি হয়। আবার শত শত কোটি টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে বকেয়া পড়ে আছে। বিতর্ক অবসানে ডিজিটাল গৃহশুমারি করে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেভাবে যৌক্তিক হারে গৃহকর নির্ধারণ করা হবে।

রেজাউল করিম চৌধুরী উপরোল্লিখিত খাতগুলোকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন।

মেয়র নির্বাচিত হলে আরো যে ২৯ টি কাজ তিনি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে সবের মধ্যে রয়েছে: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপহার চলমান প্রকল্প, মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নে বন্দরসহ সব সেবাখাতের উন্নয়ন কাজে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে জোরদার ভূমিকা ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন। বন্ধ হয়ে যাওয়া নাগরিক পরিষেবা কার্যক্রম পুনরায় চালু করা। রূপসী চট্টগ্রামের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রাকৃতিক বৈচিত্র ও পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ ও ভূ-প্রকৃতির ক্ষতি না করে উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখা। ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হবো। সুনীল অর্থনীতির সম্পদ আহরণে সরকার যে ২৬টি খাত নির্ধারণ করেছে তার বেশিরভাগই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা যাতে এই খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন এবং চট্টগ্রামের মানুষের যাতে কর্মসংস্থান হয়, তার পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগ নেবো।

তিনি বলেন, পাহাড়, হ্রদ, বনানী সংরক্ষণ, সবুজায়ন, বেড়িবাঁধ ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে উপকূলসহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস-প্লাবন থেকে নগর সুরক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হবে। কর্ণফুলী ও হালদা নদী দখল ও দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে নৌরুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ-স্টিমার সেবা চালু করে নগর পরিবহনের বাড়তি চাপ কমানো হবে। মশকমুক্ত নগর গড়তে কার্যকর ও পরিবেশ উপযোগী কীটনাশক প্রয়োগ ও বদ্ধ ডোবা, জলাশয় নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হবে। অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরি, সড়ক ও ফুটপাত দখল কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হবে। নগরীর ব্যস্ততম সব কেন্দ্রে আধুনিক পাবলিক টয়লেট ও মহিলাদের জন্য নিরাপদ টয়লেট তৈরি করা হবে। সব সড়ক ও গলি উপগলিতে পর্যাপ্ত এলইডি সড়কবাতি ও সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে। এসব স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণেও সর্বোচ্চ নজরদারি থাকবে।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, যদিও শিক্ষাসেবা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে পড়ে না, তবুও এক সময়ের জনপ্রিয় পৌর চেয়ারম্যান নুর আহাম্মদ সাহেব নগরের শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখেন। তাঁর পথ ধরে প্রথম নির্বাচিত ও সফল মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নগরবাসীকে টানা শিক্ষাসেবা দিয়ে গেছেন, যা এখনো চলমান আছে। স্বল্প খরচে শিক্ষার মানসম্মত বিকাশে আমারও সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকবে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় সিটি কর্পোরেশনের অবদান বিশাল। মহামারি করোনা আমাদের আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক করেছে। মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর টানা ১৭ বছরের মেয়াদে নগরীতে প্রসূতি সেবা ও সাধারণ চিকিৎসা সেবা দিতে বহু হাসপাতাল ও প্রসূতি সেবাকেন্দ্র তৈরি হয়, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী নামমাত্র খরচে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে, যা এখনো চালু আছে। আওতার বাইরে স্বাস্থ্যসেবাও সিটি কর্পোরেশনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। এতে মাঝে মাঝে সেবার মান ঝুলে যায়। স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখতে তিনি সাতটি পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

রাজস্বসহ সব সেবাখাতের নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করে সব সেবাকে ওয়ানস্টপ ডিজিটাল সার্ভারের আওতায় আনার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন রেজাউল করিম।

মেয়র নির্বাচিত হলে সংশ্লিষ্ট সব সেবা সংস্থার সাথে সমন্বয় করে নগরীর সব উন্নয়ন ও সেবাখাত এক ছাতার নিচে আনার ব্যবস্থা করবেন বলে জানান তিনি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নাগরিক নিরাপত্তা জোরদারে সংশ্লিষ্ট সব এজেন্সির সহযোগিতায় প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে বিশিষ্ট নাগরিক সমন্বয়ে অপরাধ নির্মূল কমিটি গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় ইশতেহারে।
সাইবার দূষণ ও আসক্তি নির্মূলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ রাখার ওপর জোর দেয়া হবে বলে অঙ্গিকার করেন রেজাউল করিম।

নারী সমাজের উন্নয়নে দু’টি পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে রেজাউল বলেন, মেয়েদের নিজস্ব নিরাপত্তা সুরক্ষায় কিশোরীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হবে এবং মহিলা উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে প্রতি ওয়ার্ডে মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। মেয়েদের জন্য আলাদা পরিবহন সেবাসহ নগরীতে যাত্রীসেবা উন্নত ও আধুনিকায়ন করতে পর্যাপ্ত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালুর উদ্যোগ নেয়া হবে।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী বলেন, দুস্থ ও বিশেষ চাহিদার নাগরিক ও শিশুদের বাড়তি যতœ ও সেবার পাশাপাশি তাদের মেধাবিকাশে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কারিগরি ও আত্মকর্মসংস্থান উপযোগী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ইন্টারনেট শিক্ষাকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেবো।

নগরীর উম্মুক্ত স্থান বা সরকারি জমি লিজ নিয়ে আধুনিক ইকোপার্ক, থিমপার্ক, শিশুপার্ক গড়ে তুলে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করে নাগরিক এবং শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ, রাস্তার যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাত দখল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, হাইড্রোলিক হর্ন, মাইক বিশেষ করে রাত দশটার পর মাইক ব্যবহার ও শব্দ দূষণ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়ার পকিল্পনা ব্যক্ত করেন রেজাউল।

তিনি বলেন, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও সৃজনশীল সব কাজে উৎসাহ ও বইপড়া কর্মসূচি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করা হবে। কারণ মানসিক, শারীরিক উৎকর্ষ ছাড়া কোন সুস্থ ও মননশীল জাতি গড়া সম্ভব নয়। সাধ্য ও সহযোগিতার মেলবন্ধনে বহুমুখী সাংস্কৃতিক ও ডিজিটাল পাঠাগার কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও অনুশীলনকে সর্বাধিক উৎসাহিত করা হবে। নগরীর বিউটিস্পট পাহাড়কাটা বন্ধ, জলাধার, পুকুর দিঘি ভরাট কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

রেজাউল করিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় গৌরবের সবচেয়ে বড় কীর্তি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ, বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও সুরক্ষায় মনোযোগ দেয়া হবে। নগরীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধ-লাঞ্ছিতা মা-বোনদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে। কিশোর অপরাধের কারণ ও কিশোর অপরাধী গ্যাং, মাদক ও অপরাধের আখড়া গুঁড়িয়ে দিয়ে নাগরিক স্বস্তি নিশ্চিত করা হবে। নাগরিক তথ্যসেবাসহ সব সেবা কেন্দ্রীয় সার্ভার নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে। নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলাসহ ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমষ্টিগত স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ নাগরিক গড়ে তুলতে প্রতি ওয়ার্ডে নাগরিক উদ্ধুদ্ধকরণ পর্ষদ গঠন করা হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সমন্বয়ক করে সর্বস্তরের বিশিষ্ট নাগরিক সমন্বয়ে এই পর্ষদ গঠিত হবে। প্রতিমাসে তারা বৈঠক করে সচেতনতার অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এর বাইরে কাজের সময় চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে অন্য সমস্যাগুলো সমাধানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উপসংহারে তিনি বলেন, অঙ্গীকারের স্বপ্নের কাচ্চি বিরিয়ানি নয়, নগরীর বিপুল জনগোষ্ঠীকে ন্যূনতম সেবা দিতে পারাটাই আসল যোগ্যতা। সকলের সহযোগিতা পেলে যোগ্যতার পরীক্ষায় জিতব বলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী। আমার কিছুই পাওয়ার নেই, পারিবারিকভাবে সব পার্থিব অর্জন আমার আছে। সুযোগ পেলে নিজের মেধা-মনন, কর্ম সবকিছু নগরবাসীর জন্য উৎসর্গ করাই আমার আসল অঙ্গীকার। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। চিরজীবী হোক প্রিয় বাংলাদেশ।

ইশতেহার ঘোষণাকালে অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালাম, সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান প্রমুখ।

‘রূপসী চট্টগ্রাম আমার-আপনার অহঙ্কার, অঙ্গীকার-সবার যোগে সাজবে নগর’ শিরোনামে এ ৩৭ টি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘোষণার আগে সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী বলেন, চট্টগ্রাম প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। ঘন সবুজের দেয়াল ঘেরা পাহাড়, নদী, সাগর, হ্রদ, ঝিলের সমন্বয়ে প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়েছে চট্টগ্রামকে। প্রাকৃতিক রূপের এমন উপহার পৃথিবীতে খুব কমই আছে। দেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। জাতীয় অর্থনীতি চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। জাতীয় আমদানি-রপ্তানির ৮৫ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। স্বাভাবিক কারণে চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১২ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বমানের গতিশীল আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত হয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সুবিধা ধাপে ধাপে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার খুলতে এগিয়েছে অনেক দূর। প্রতিবেশি ভারতের ভূমিবেষ্টিত সেভেন সিস্টার, চীনের কুনমিংসহ নেপাল, ভূটানেরও আমদানি রপ্তানির ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হবে চট্টগ্রাম। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিশাল উৎসমুখ খুলে যাবে শিগগিরই। পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম পর্যটন তীর্থ হিসেবে গড়ে উঠবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। সমুদ্র অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনা বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বিশ্ব অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (হাব) আসন দখল করবে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামকে এই অবস্থানে তুলে আনতে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার। সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর চট্টগ্রামসহ জাতির বিপুল সম্ভাবনা হাজার বছর পিছিয়ে দেয় ঘাতক চক্রের সহযোগী সরকারগুলো। নানা অব্যবস্থাপনা ও দখল, লুটপাটের মাধ্যমে দেশকে পরনির্ভর ও পঙ্গু করে দেয়া হয়। চট্টগ্রামকে নিয়ে চলে নানামুখী ষড়যন্ত্র। ফলে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং নান্দনিক মহানগরের উন্নয়নও থমকে যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে তুলে এনে বিশ্ব দরবারে অনন্য মর্যাদা এনে দিয়েছেন। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বৈশ্বিক রোল মডেল। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে করোনা সঙ্কটেও তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। করোনা সঙ্কট মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর প্রশংসা কুড়িয়েছে। পরম সৌভাগ্যবান হয়েও আমরা প্রকৃতির চমৎকার উপহার চট্টগ্রামকে ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছি না। এর জন্য শুধু দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ নয়, চট্টগ্রামের গর্বিত নাগরিক হিসাবে সবাই সমান দায়ী। একটি জনপদ বা নগর তখনি নান্দনিক, পরিচ্ছন্ন, পরিবেশবান্ধব ও বাসোপযোগী হয়, যখন সব নাগরিক নিজের বাসগৃহের মতো এটার যতœ নেয়। আমরা পারিনি কারণ অধিকার বা দাবি সচেতন হলেও আমাদের মাঝে নাগরিক দায়িত্ব পালনের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমি নিজেও এই দায় এড়াতে পারি না। আপনাদের মিলিত প্রচেষ্টায় অতীতের সব ভুল ছুঁড়ে ফেলে চট্টগ্রামকে সর্বাধুনিক বাসোপযোগী বিশ্বমানের উন্নত ও নান্দনিক নগর হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। চট্টগ্রাম বন্দরকে সর্বোচ্চ গতিশীল রেখে সাজাতে হবে চট্টগ্রাম নগরীকে। নগরবাসীর সেবক হিসেবে ২৭ জানুয়ারি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আপনাদের রায় ও দোয়া চাই।

আমারসংবাদ/জেআই