ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১, ১১:১০ এএম
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জনপ্রিয় তাঁতের বস্ত্র শিল্প ঐতিহ্য হারাচ্ছে। গ্যাসের ব্যবহার না থাকা, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেকটা বিলুপ্ত প্রায় এই শিল্পটি। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এখন জরুরি।
তাঁত বোর্ডের তথ্য মতে, জেলায় ১৫ হাজার পাওয়ার লুম ও ২ হাজার হ্যান্ডলুমে ১ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। তাঁতের বস্ত্র শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরা করোনা কালীন সময়ে দুর্দিনের মধ্যে দিনানিপাত করছে। তাঁত মালিকরা রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কটে। সুতা, রং ও কাঁচামালের মূল্য উদ্ধগতি আর নানান প্রতিকূলতার কারণে এককালের প্রসিদ্ধ এই শিল্প বিলুপ্ত হতে চলছে। একের পর এক বন্দ হচ্ছে কারখানা। এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজার-হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে তারা অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে। বস্ত্র তৈরিতে গ্যাসের ব্যবহার না থাকা, সকল কাঁচামালে মূল্যবৃদ্ধির ফলে জাতীয় বাজারে কুমারখালীর এই শিল্পটি টিকে থাকতে পারছে না।
তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত খয়েরচারা-ঝাউতলার সাহেব আলী জানান, উপজেলা জুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় তাঁতের গামছা তৈরি হয় এখন।
তিনি আরো জানান, মূলত অব্যহত লোকসান ও পৃষ্ঠপোশকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে কুমারখালীর ঐতিহ্যবাহী তাঁতের গামছা শিল্প। যদুবয়রার গামছা কারিগর আব্দুল গফুর বলেন, এক সময় উপজেলার তাঁত পল্লীগুলো তাঁতের খটখট শব্দে রাত-দিন মুখরিত থাকতো। আজ সেখানে স্থির নীরবতা। তবু বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে কোনোমতে টিকে আছে কয়েকটি পরিবার।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর স্থানীয় ভাষায় তাঁতীদের কারিগর বলা হয়। সুতো কিনে বিভিন্ন রং মিশিয়ে নিজেদের তাঁতে সুনিপুণ হাতে বস্ত্র তৈরি করে থাকে তাঁতীরা। এক সময় জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হত এই তাঁতের চাদর, বেডশীট, তোয়ালে ও গামছা। আজ সেটার পাট্টা বেডশীট অনেকটাই হারানো স্মৃতি। প্রিন্ট চাদর সেই স্থান দখল করেছে। তাঁতশিল্পের সমস্যার সমাধান না করা গেলে পাট্টা চেকের বেডশীটের মত গামছাও কুমারখালী থেকে হারিয়ে যাবে অচিরেই। প্রিন্ট বেডসীটের মত হয়তো একদিন আমদানী নির্ভর ব্যবসা করতে বাধ্য হবে সংশ্লিষ্টরা। জন্ম নেবে তাছলিমা টেক্সটাইলের মত পাইকারী ব্যবসায়ীর।
জীবনের শুরু থেকে বাপ-দাদার এই পেশায় সারাদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিল কুমারখালী শহরের তেবাড়িয়ার জাফর শেখ। জাফর শেখের গামছা সারাদেশে রপ্তানি হতো। তার অনুপস্থিতিতে ছেলে খোকন শেখ অনেক কষ্টে তাদের পেশা আঁকড়ে আছে। জাফর শেখের বড় ছেলে জহুরুল বাবার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুটি তাঁতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তোয়ালের কদর বেশ বেড়েছে। অনেক কারখানা শুধু তোয়ালের উপর নির্ভর করে টিকে রয়েছে। রয়েল রিপন টেক্রটাইলের তোয়ালে সুনাম কুড়াচ্ছে।
এক সময় কুমারখালী, খোকসা, কুষ্টিয়া মিরপুর, রাজবাড়ীর পাংশা, লাঙ্গলবাঁধ এলাকায় প্রায় ৮০ হাজারেরও অধিক তাঁতী ছিল। এর মধ্যে খটখটি তাঁত ১৪ হাজার, হস্তচালিত পিটলুম তাঁত ৪৪ হাজার ও বিদ্যুৎ চালিত ২০ হাজার তাঁত ছিল। এসব তাঁতে ২ কোটি ৮৮ লাখ পিচ লুঙ্গি, ১৫ লাখ পিস বেডকভার, ৭২ লাখ পিস গামছা-তোয়ালে উৎপাদন হত। সে সময় এ জেলায় বস্ত্রশিল্পের বার্ষিক আয় ছিল ৩শ’ কোটি টাকার উপরে। দেশের মোটা কাপড়ের চাহিদার ৬৩ ভাগ পূরণ করতো কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর তাঁতীরা। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই তাঁত কাপড়ের ছিল ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে এ চাহিদা কমে ৩৫ ভাগে নেমে এসেছে। কাপুড়িয়া হাট হারিয়েছে তার সুনাম-সুখ্যাতি। তাঁতী সমাজ মোটা লুঙ্গি তৈরি করে কোন মত বেঁচে আছে। কেউ কেউ সাহজাদপুরের মত চিকন সুতির লুঙ্গি তৈরি করে কষ্টের মধ্যেই জীবন জীবিকা চালাচ্ছে।
এদিকে কুমারখালী শহরে ৪টি কাপড় প্রসেসিং মিল ও ৩টি ফিরোজা রংয়ের ডাইং বস্ত্র শিল্পে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের সেবা আশানুরূপ না পাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বাণিজ্য মেলায় কুমারখালীর বুলবুল টেক্সটাইল, ইষ্টার্ন ফেব্রিকস, রানা টেক্সটাইল, নুরুল টেক্সটাইল ও কুষ্টিয়া হস্তশিল্প ইতোপূর্বে বার বার পদক প্রাপ্ত হলেও কুমারখালীর বস্ত্র তাদের গৌরব ধরে রাখতে পারছে না।
সনাতন পদ্ধতির তাঁত ফেলে দিয়ে চীনের পরিত্যক্ত ‘রেপিয়র‘ তাঁত আমদানী করে ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে রানা টেক্সটাইল এর পরিচালক শিল্পপতি মাসুদ রানা জানিয়েছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সব কিছুর দাম বাড়লেও আশানুরুপ তাঁতবস্ত্রের দাম না বাড়ায় কুষ্টিয়ার ১ লাখ ১৪ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৫০ হাজার তাঁত শ্রমিক পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও পুরাতন পেশা হিসেবে এ পেশায় টিকে আছে কয়েক হাজার তাঁতী। কুমারখালীর ঐতিহ্য তাঁত শিল্প, এই শিল্পের গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে, বিনাসুদে লোন সুবিধাসহ নতুন কর্ম পদ্ধতি প্রনয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন তাঁত শ্রমিক, মালিক ও কুমারখালীর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমাজ।
আমারসংবাদ/কেএস