Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

উলিপুরে ঐতিহাসিক স্থাপত্য মুঘল আমলের কাজীর মসজিদ

কামরুজ্জামান স্বাধীন, উলিপুর (কুড়িগ্রাম)

ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১, ১২:২০ পিএম


উলিপুরে ঐতিহাসিক স্থাপত্য মুঘল আমলের কাজীর মসজিদ

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮কিলোমিটার পশ্চিমে দলদলিয়া ইউনিয়নে দলবাড়ির পাড় গ্রামে অবস্থিত মসজিদটি। 

কালের স্রোতে চাপা পড়া মসজিদটি ঐ এলাকায় হাজারো মানুষের হৃদয়াঙ্গম করে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। পূর্বের গম্বুজ আকৃতির মসজিদটিকে ঘিরে নির্মিত হচ্ছে এ আমলের আরেক ইতিহাস।  

মুঘল আমলের মসজিদটি বালু সিমেন্ট ব্যবহার না করে চুন সুরকি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন কারু শিল্পীরা। মসজিদের পুরাতন ভবনটি ৩টি গম্বুজ বিশিষ্ট শক্ত ভিত্তির উপর দন্ডায়মান। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট ও প্রস্থ ১৩ ফুট। দেয়ালের পুরত্ব প্রায় আড়াই ফুট। 

বর্তমানে মসজিদটির ছাদে ৫টি গম্বুজ ও ছোট ছোট ৪টি মিনার সমপ্রসারিত হয়েছে। অতি পুরাতন হওয়ায় মসজিদটির কিছু অংশ মাটিতে দেবে গেছে। 

মূল মসজিদের মধ্যে একটি ছোট মেহরাব রয়েছে জুম্মার দিন খতিব এখান থেকে ইসলাম ধর্মের বয়ান পেশ করেন। মসজিদটির ভিতরে মোট ১৫-২০ জন মুসল্লী একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। 

ভিতরে সাদা মাটা থাকলেও বাইরে খচিত অলংকরণ বেশি হওয়ায় আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এই মসজিদটি সমপ্রসারিত করে অত্যাধুনিক ও নিপূণ কারুকাজে সৌন্দর্য বৃদ্ধী করা হচ্ছে।  

এ নিদর্শনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, মসজিদের পূর্বদিকে প্রাচীনকালের সান বাঁধানো একটি পুকুর ও নতুন একটি কবরস্থান। মসজিদের উত্তরে ঈদগাহ মাঠ, হাফিজিয়া মাদরাসা, লিল্লাহ্ বোর্ডিং, দক্ষিণে নূরানি মাদরাসা ও পশ্চিমে কবরস্থানসহ প্রায় ৩ একর জমি ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে ঘিরে গ্রামের মানুষের মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক প্রচলিত কথা যা হার মানায় রূপকথাকেও।

কখন, কিভাবে নির্মিত হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি। এ ব্যাপারে দুটি মতবাদ রয়েছে, মসজিদটি আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, যা গায়েবি ভাবে ভূ-গর্ভ থেকে উঠে এসেছে, অন্যটি সেই মুঘল আমলের কাজী কুতুব উদ্দিনের তৈরি। 

উলিপুরের ‘ইতিহাস ও লোকসাহিত্য গ্রন্থ’ থেকে জানা যায়, ১২১৪ হিজরী সনে পারস্য (ইরান দেশ) থেকে কাজী কুতুব উদ্দিন নামের একজন ধর্মযাজক ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য অত্র অঞ্চলে এসে মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি এলাকায় ধর্ম প্রচার করে মুসল্লীদের নিয়ে এই মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। 

ওই ধর্মযাজক চলে যাওয়ার পরে এলাকার মুসল্লীরা দীর্ঘসময় সেখানে নামাজ আদায় করলেও কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে সেখানকার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মসজিদটি ঝাড় জঙ্গলে ঢেকে যায়। 

মসজিদটির নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তি তর্কের সমাধান হয়, মূল মসজিদের প্রবেশের পথে একটি ফার্সি ভাষার শিলালিপি থেকে। যার বঙ্গানুবাদ: পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। 

আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নাই, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল। কাজী কুতুব উদ্দিন সাহেব, ঈমানী দৃঢ় বিশ্বাসে পবিত্র আল্লাহর ঘর মসজিদ নির্মাণ করেন। নবী (সাঃ) এর অছিলায় প্রতিষ্ঠার কাজ সোমবারে সমাপ্ত হয়েছে।

হিজরী সাল তালাশ করে জানা যায় ১২১৪ সনে মসজিদটির নির্মাতা হচ্ছেন কাজী কুতুব উদ্দিন। তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় কাজীর মসজিদ। 

ধারণা করা হয়, তিনি ছিলেন উপমহাদেশে ধর্ম প্রচার করতে আসা রাসুল (সাঃ) এর নায়েবে নবী। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ কাজীর মসজিদটি অধিগ্রহণ করে। 

সপ্তাহে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এক নজর মসজিদটি দেখা ও মানতের জন্য ভিড় করছেন। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১৫ শতাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাগম ঘটে।

কথিত আছে, এই মসজিদে কেউ কিছু মানত করে দান করলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। মসজিদটিকে কেন্দ্র করে প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলী মানুষ-জনও বিভিন্ন মানত (নগদ টাকা, চিনি, গুড়, পায়েস, খোরমা, জিলাপি, খিচুড়ি, হাঁস-মুরগী, ছাগল, চাউল, ডাল ও ধর্মীয় বই) সামগ্রী নিয়ে এসে মসজিদ কমিটির হাতে তুলে দেন।

এসব মানত ও দান থেকে প্রতিমাসে প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা উপার্জিত হয়। কাজীর মসজিদের খতিব মাও: মো. আব্দুস সবুর জানান, আমি দীর্ঘ ৫০ বৎসর যাবত এই মসজিদের প্রধান খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, আমি যতটুকু জানি মসজিদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। 

এক সময় এলাকার লোকজন মসজিদটি আবিষ্কারের পর পুনঃসংস্কার করেন। তখন থেকে মুল মসজিদটিতে ১৫/২০জন মুসল্লী নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। নামাজের জায়গা কম হওয়ায় মসজিদটি সমপ্রসারণ করা হয়েছে।  

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহের দান ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মুল মসজিদটি ঠিক রেখে ৫ তলার ভিত্তি দিয়ে ২য় তলার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে মসজিদ, মাদরাসা ও কবরস্থান সমপ্রসারণ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন।

মুঘল আমলের বিশেষ স্থাপত্যের তৈরির স্মৃতিচিহৃ কাজীর মসজিদ উত্তরবঙ্গে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশে সমগ্র মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম চিত্রাকর্ষক স্থাপনা এই মসজিদ।

আমারসংবাদ/এআই