ডিসেম্বর ৫, ২০২১, ১২:২৫ পিএম
নিঃস্ব অবস্থায় চাকরিতে ঢুকলেও বর্তমানে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালিউল্লাহ। তিনি এখন এলাকাবাসীর বিস্ময়। সম্প্রতি তার শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের উৎস খুঁজতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগ রয়েছে, উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালিউল্লাহর ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ২৭ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্তের দায়িত্ব দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাস পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
এসআই ওয়ালিউল্লাহর বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ঘুষের টাকা দিয়ে তিনি রাজধানীর রাজারবাগে ৭তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। উত্তরায় বাড়িসহ জমি কিনেছেন, খিলক্ষেত এলাকায় কিনেছেন জমি। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ এলাকায় জমি ও নেত্রকোনায় বাড়ি এবং জমি কিনেছেন। সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহেও রয়েছে তার কেনা সম্পত্তি। বিলাসবহুল প্রাইভেটকারসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপসহকারী পরিচালক প্রবীর কুমার দাসকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সিআইডি'র এসআই ওয়ালিউল্লাহর বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কলুঙ্কা গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল কুদ্দুছ তারা মিয়া।
কলুঙ্কা গ্রামের কয়েকজন জানান, ওয়ালিউল্লাহ দুদক থেকে বাঁচতে সব সম্পদের বেশির ভাগই মা-বাবা, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের নামে দিয়ে রেখেছেন। আত্মীয় স্বজনদের অনেকের নামেই করে রেখেছেন বিশাল অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স। অসম সম্পদের হিসেব সহজ করতে এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপ ব্যবসার লাইসেন্সও করেছেন। এখানেই শেষ নয়, নিজেকে ঋণগ্রস্ত দেখাতে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন কোটি টাকার ঋণ।
তারা জানান, ওয়ালিউল্লাহর অনেক সম্পদ সবগুলো সবার জানা নেই। তবে দৃশ্যমান সম্পদের মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর রাজারবাগে চার কাঠা জায়গার ওপর একটি সাততলা বাড়ি ও উত্তরায় চার কাঠা জমির ওপর আরও একটি সাততলা বাড়ি। রাজধানীর খিলক্ষেত ও নারায়ণঞ্জ জেলা শহরে রয়েছে জমি কিনেছেন ওয়ালিউল্লাহ। এ ছাড়া ময়মনসিংহে বহুতল ভবন রয়েছে। নেত্রকোনায় আধুনিক সদর হাসপাতালের সামনে আছে ছয়তলা একটি বাড়ি, শহরের নতুন জেলাখানা এলাকায় রয়েছে ৪০ শতক জায়গা। মোহনগঞ্জ শহরের মহিলা কলেজের পেছনে ও থানা মোড়ে রয়েছে দুটি বড় প্লট। উপজেলার সামাইকোনা সেতু সংলগ্ন এলাকায় তিন কোটি টাকার জমি। ধর্মপাশা শহরে ১০ শতক জায়গার ওপর একটি বাসা রয়েছে। একই শহরের পূর্বপাশে একটি দোকান রয়েছে।
তারা আরও জানান, নিজের ব্যবহারের জন্য রয়েছে দুটি গাড়ি। একটি প্রাইভেট কার ও অপরটি নোয়া মাইক্রোবাস। এ ছাড়া গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ২৫ একর আবাদি জমি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকার মতো। মামার বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ডিগজান এলাকায় রয়েছে ৩৫ একর জমি। পাশাপাশি দুটি মাছ ধরার বড় জলাশয়ও কিনেছেন ওয়ালিউল্লাহ। ওখানেও রয়েছে তার ক্যাডার বাহিনী। তার বিরুদ্ধে গেলে শুরু হয় নির্যাতন। যুবকদের মাঝে টাকা বিলিয়ে বানিয়েছেন এ বাহিনী। উপজেলার অসম সম্পদের হিসেব সহজ করতে এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপ ব্যবসার লাইসেন্সও করেছেন। এখানেই শেষ নয়, নিজেকে ঋণগ্রস্ত দেখাতে ব্যাংক থেকে নিয়েছেন কোটি টাকার ঋণ।
স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে পুলিশের কনস্টেবল পদে যোগ দেন ওয়ালিউল্লাহ। পরে ২০১৫ সালে এএসআই ও ২০১৮ সালে এসআই পদে পদোন্নতি পান। তাদের পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। ওয়ালিউল্লাহরা দুই ভাই ও তিন বোন। তার ছোট ভাই সোহাগ তালুকদার কিছুদিন আগে মালা নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন পেতে নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। অবশেষে নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কলুষ্কা গ্রামের বাসিন্দা মো. সবুজ মিয়া জানান, ওই পরিবারে ওয়ালিউল্লাহই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার ছোট ভাই সোহাগ কিছুই করে না। চাকরি পাওয়ার আগে গ্রামে তাদের বাড়ি ও প্রায় ৫ শতাংশ জমি ছিল মাত্র। এই কয় বছরে পুলিশে চাকরি করে কীভাবে এত সম্পদ করেছে তার হিসেব এলাকায় কেউ মিলাতে পারছে না। এখন চারদিকে তাদের শুধু সম্পদ আর সম্পদ। নামে-বেনামে কত সম্পদ যে আছে, তার কোনো হিসেব নেই। ছুটিতে বাড়িতে আসলে এক-দুইটা গরু জবাই করে আয়োজন করে তার পরিচিতজনকে খাওয়ানোর জন্য।
তিনি বলেন, এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। যে-ই তার বিরুদ্ধে যাবে, তাকেই মামলা হামলা দিয়ে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে জেল খেটেছে এলাকায় এমন অনেক মানুষ আছে।
কলুঙ্কা গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুইজন জানান একই তথ্য।
তারা জানান, ওয়ালিউল্লাহর দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণই শতকোটির বেশি হবে। এ ছাড়া অজানা যে কত সম্পদ আছে সেটার পরিমাণ অনেক হবে। তার ভয়ে এসব কেউ খুঁজতে যায় না। এগুলো খুঁজতে গেলেও মামলা খেতে হবে। ওয়ালিউল্লাহর বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমি জেল খেটেছি। একবার আমায় মিথ্যা মানবপাচার মামলায় জেল খাটিয়েছে। তার পাহাড় সমান টাকা। সবকিছু তার পক্ষে। এলাকার কেউ এখন আর তার বিরুদ্ধে কথা বলে না। তার যে শতকোটি টাকার সম্পদ এটা তো দুদকও জানে।
ওয়ালিউল্লাহর মামার বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ডিগজান গ্রামে। তার মামার পরিবারের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওয়ালিউল্লাহর সম্পদ শতকোটির বেশি অনেক হবে। ওয়ালিউল্লাহর মা-বাব ভাই, বোন, বন্ধুবান্ধব সহ মামা-মামী, মামাতো ভাই, বোনদের নামেও বড় অঙ্কের ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। তবে ওয়ালিউল্লাহ এলাকায় গরীব মানুষকে সহায়তা করেন বলেও জানান তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে এসআই ওয়ালিউল্লাহর মোবাইলে একাধিক কল ও খুদে বার্তা দিলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে দুদকের ময়মনসিংহ বিভাগের উপ-পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, এসআই ওয়ালিউল্লার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছিল। আমরা সেই অভিযোগটি ঢাকায় আমাদের দুদকের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।
আমারসংবাদ/কেএস