Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

বিদ্রোহীতে ডুবছে নৌকা

প্রিন্ট সংস্করণ॥আসাদুজ্জামান আজম

মার্চ ২২, ২০১৯, ০৫:০৫ এএম


বিদ্রোহীতে ডুবছে নৌকা

 

চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নমনীয় থাকার কারণে তৃণমূলে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন দল মনোনীত প্রার্থীরা। কোথাও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জয় ছিনিয়ে নিচ্ছেন দলের বিদ্রোহীরা। আবার কোথাও বিদ্রোহীদের কারণে জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সব দিকে জয়জয়কার অবস্থা থাকলেও উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের কারণে ডুবছে নৌকা। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে এমনটাই ফুটে উঠেছে। যার কারণে পরবর্তী ধাপগুলোতে নৌকার পরাজয়ে শঙ্কা বাড়ছে।
তথ্য মতে, বিএনপি, ঐক্যফ্রন্টসহ সরকারবিরোধী দলগুলো নির্বাচনে না আসায় অধিকাংশ উপজেলায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এজন্য উপজেলা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে দলের বিদ্রোহীদের বিষয়ে কোনো প্রতিবন্দ্ধকতা দেখায়নি আওয়ামী লীগ। পুরুষ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ উন্মুক্ত রাখা হয়। চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী দিলেও বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানো হয়। তবে ভোটের মাঠ বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো বর্জন করলেও আমলে নেয়নি তৃণমূল নেতারা। দলীয় সিনিয়র নেতাদের কড়াকড়ি বার্তা উপেক্ষা করেই প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় নেতারা। ঘোষিত তফসিলের ৪ ধাপেই অন্তত দেড় শতাধিক উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কয়েক শতাধিক নেতা। প্রার্থী হওয়ায় ওইসব প্রার্থীদের বহিষ্কার করা হলেও তারা নির্বাচন থেকে সরে আসেননি। স্থানীয় রাজনীতিতে দলের এবং নিজস্ব বলয়ের প্রভাব কাটিয়ে নির্বাচনি কার্যক্রম চালাচ্ছেন। অন্যদিকে, কেন্দ্রের নমনীয়তার সুযোগে অধিকাংশ উপজেলায় চেয়ারম্যানসহ দুই ভাইস চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। যেসব উপজেলায় বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, ওইসব উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা সদর্পে রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক উপজেলায় নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে স্থানীয় সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যরা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, যারা বিদ্রোহী হয়েছেন, তাদের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে এবং দলীয় ফোরামে উঠানো হবে। বিদ্রোহী হওয়ার জবাব চাওয়া হবে। প্রথম ধাপে ১৯ উপজেলায় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও অন্য দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। গত ১৮ মার্চ দ্বিতীয় ধাপেও দাপট দেখিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক জয়ী হয়েছে ৫২টি উপজেলায়। স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ৩৫টি উপজেলায়। দ্বিতীয় ধাপে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোশারফ হোসেন (ভিপি মুশা), আলফাডাঙ্গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম জাহিদুল হাসান, সদরপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শফিকুর রহমান, ভাঙ্গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আল হাবিব, সালথায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ওয়াদুত মাতুব্বর নির্বাচিত হন।সিলেটের ১২ উপজেলার মধ্যে ৭টিতে আওয়ামী লীগ ও ৫টিতে দলের বিদ্রোহী ও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন। ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের তিনটি পদেই বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ওই উপজেলায় সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মইনুল হক চৌধুরী (ধানের শীষ) ২০ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আখতারুজ্জামান জগলু চৌধুরী (ঘোড়া) ১৮ হাজার ৬৭৮ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আতাউর রহমান পেয়েছেন ১০ হাজার ৫৮ ভোট। দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। গোয়াইনঘাট উপজেলায় চেয়ারম্যান হয়েছেন আ.লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারুক আহমদ। উপজেলা বিএনপির সম্পাদক (বহিষ্কৃত) শাহআলম স্বপনের চেয়েও আট হাজার ভোট কম পেয়েছেন উপজেলা আ.লীগের সম্পাদক দলীয় প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া হেলাল। মৌলভীবাজারের সাতটি উপজেলার মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। রাজশাহী বিভাগের ১০ উপজেলায় বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বগুড়া জেলায় ৩টি উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। গাইবান্ধায় দুটিতে এবং নওগাঁ জেলায় ১টিতে জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। রাঙামাটিতে ৩টি এবং কক্সবাজারে ২টি জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র। দিনাজপুর জেলার ৪ উপজেলায় জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র ও একটিতে জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা পরিষদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জামায়াত নেতা ফয়সাল মুরাদ নির্বাচিত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি প্রার্থী জহিরুল ইসলাম মবিন নির্বাচিত হয়েছেন। বান্দরবানের আলীকদমে ৯ হাজার ১৮১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবুল কালাম। তৃতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৪ মার্চ। তৃতীয় ধাপের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে রয়েছেন। বিদ্রোহীদের দাপটে কোণঠাসা চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর ও দামুড়হুদা উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রতীকের প্রার্থীরা। উপজেলা দুটিতে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন খোদ সরকার দলীয় সাংসদের পরিবারের সদস্যরা। সাংসদের প্রভাবে প্রশাসনের সহায়তায় মাঠে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে ওইসব প্রার্থী। ৩১ মার্চ চতুর্থ ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনে কুমিল্লা জেলার ৮ উপজেলায় দলের ‘বিদ্রোহী’ স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কারণে জয় কঠিন হবে নৌকার প্রার্থীদের। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ ধর্মীয় কয়েকটি দলের নেতাকর্মীরাও বিদ্রোহীদের পক্ষে রায় দেবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ৮টি উপজেলায় নৌকাপ্রতীকের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে রয়েছেন বিদ্রোহীরা। নিজ বলয় ভারী করতে গিয়ে ভিন্ন মতাদর্শের নেতাদের মাঠে সক্রিয় করে তুলছেন। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সাংসদদের আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের পক্ষে থাকা উচিত। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিএনপি ও জামায়াতের ভোট টানতে চান। তাহলে তারা বিজয়ী হয়ে কি ওদের পুনর্বাসন করবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথমে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান স্থানীয় সাংসদ এবাদুল করিম বুলবুল সমর্থিত প্রার্থী হাবিবুর রহমান স্টিফেন। স্টিফেনকে প্রার্থী ঘোষণা করার পরই গত ৫ মার্চ উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা আহবান করা হয়। কিন্তু ওই প্রার্থীর দ্বৈত নাগরিকত্বসহ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত থাকার অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জহির উদ্দিন সিদ্দিক টিটু। ওই প্রার্থী সাংসদসহ একটি পক্ষের পছন্দনীয় না হওয়ায় বর্ধিত সভা মুলতবি করা হয়। একই সঙ্গে একজন বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তার পক্ষ নেন তারা। শুধু প্রার্থী নয়, দলীয় নেতাকর্মীদের নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থীর পক্ষ নেন সাবেক এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এরপর ১৭ মার্চ নবীনগরে মুলতবি সভা ডাকা হলেও সংঘাতের আশঙ্কায় স্থগিত করা হয়। সেই স্থগিত সভা আজ ২২ মার্চ সভাপতির ঢাকাস্থ ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। নিজ এলাকার বাইরে বর্ধিত সভা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ল হয়ে উঠেছেন। উল্লেখ্য যে, উপজেলা আওয়ামী লীগের অননুমোদিত কমিটির মেয়াদ ইতোমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বলে জানা যায়।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুল উল আলম হানিফ বলেন, বিদ্রোহীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই, তবে দলের প্রার্থীর বিজয়ে বাধা হতে পারে এমন প্রার্থীদের ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।