Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

রাজউকের নজর শুধু নতুন উন্নয়ন প্রকল্পে!

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ৩০, ২০১৯, ০৬:৩১ পিএম


রাজউকের নজর শুধু নতুন উন্নয়ন প্রকল্পে!

পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নির্ধারিত বিধিবিধানের আলোকে ঢাকাকে পরিকল্পিত মহানগরীতে রূপ দিতে যেসব বিধিমালা রয়েছে তাতে নজর না দিয়েই নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের সন্ধানে ব্যস্ত প্রতিষ্ঠানটির কর্তারা। নিরাপদ মহানগরী গড়তে প্রণীত সবকটি বিধিমালার মধ্যে ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা, ২০০৮ রাজউক কর্তৃক উপেক্ষিত নিজস্ব বিধিমালার একটি। ভবন ব্যবহারের আগে ব্যবহার বা বসবাসের সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রেখেই ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা, ২০০৮ প্রণয়ন করা হলেও আদৌ এ বিধিমালার বাস্তব অস্তিত্ব সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে শুধুই কাগজ-কলমে।ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা, ২০০৮-এর ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মিত হওয়ার পর তা ব্যবহার অথবা সেখানে বসবাসের জন্য বসবাস বা ব্যবহার সনদ গ্রহণ করতে হবে। আবার ১৯ (১) ধারায়ও এর পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে, আংশিক বা সম্পূর্ণ বসবাস বা ব্যবহার সনদ পাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবনটি নির্মিত হয়েছে কিনা, তা পরিদর্শন করে ১৫ দিনের মাথায় এ সনদ পাওয়া যাবে বলে বিধিমালার ১৯-এর (৫) ধারায় উল্লেখ করা রয়েছে। বিধিমালায় ব্যবহার বা বসবাস সনদের ওই মেয়াদও নির্দিষ্ট করা হয়েছে পাঁচ বছর। এ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই এটি নবায়ন করার বিষয়টিও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সনদ ছাড়া নির্মিত ভবনে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনসহ কোনো ধরনের পরিষেবার সংযোগ না দেয়ার বিধানও রয়েছে। অথচ ইমারত বিধিমালা ২০০৮ কার্যকরের পরও রাজধানীতে গত ১০ বছরে নির্মাণ হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি ভবন। তবে এসবের বিপরীতে রাজউক থেকে ব্যবহার বা বসবাসের সনদ সংগ্রহ করেছে ২০০টির কমসংখ্যক ভবনের মালিক। এ হিসেবে বলা চলে রাজউক নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি ভবন। এ নিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে ভবন মালিকদের দায়ী করে রাজউক বলছে, মালিকরা তাদের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েই ভবন নির্মাণ করেন বলে এ সনদ গ্রহণে আগ্রহ দেখা যায় না। কারণ বসবাসযোগ্যতার সনদ গ্রহণের আবেদনের সঙ্গে কয়েকটি তথ্য জমা দিতে হয়। এগুলো হলো- ভবন নির্মাণের সমাপ্তি প্রতিবেদন, কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত স্থাপত্য নকশার ভিত্তিতে নির্মিত ইমারতের নির্মাণ নকশা, ইমারতের কাঠামো নকশা ও ইমারত সেবাসংক্রান্ত সব ধরনের নকশা। অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটলে এ সনদ পাওয়া যায় না বলে ভবন মালিকরা এটি গ্রহণ করেন না। যদিও এ সনদ গ্রহণ বা নবায়ন না করা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি রাজউক। পরিকল্পনাবিদদের মতে, ইমারত বিধিমালা, ২০০৮ যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের ব্যর্থতাই দায়ী। রাজউক যদি শুধু এ আইনটিরই বাস্তবায়ন ঠিকভাবে তদারকি করত, তাহলে রাজধানীতে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা অনেক কম হতো। সংস্থা হিসেবে রাজউক নিজস্ব দায়িত্ব পালন না করে উন্নয়ন প্রকল্পেই বেশি আগ্রহী। দায়িত্ব পালনে রাজউকের ব্যর্থতার কারণেই সাধারণ জনগণকে জীবন দিতে হচ্ছে। এটি মেনে নেয়া যায় না। আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী অবকাঠামো তদারকির দায়িত্ব রাজউককে পালন করতে হবে, না হলে এটি কোনো তৃতীয় পক্ষের হাতে ছেড়ে দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, জানমালের নিরাপত্তায় কোনো ছাড় গ্রহণযোগ্য নয়। এদিকে, ব্যবহার সনদ ছাড়াই ভবন ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় এক সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে একটি নির্দেশিকা জারি করলেও খোদ রাজউককেই এ বিধানটির প্রয়োগে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। রাজধানীর পূর্বাচল ও উত্তরা জোনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জানুয়ারিতে পরিচালিত এক অভিযানেও রাজউকের অকুপেন্সি সনদ ছাড়াই বিভিন্ন ভবনে পরিষেবা সংযোগ দেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। আগের বিধিমালায় অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেয়ার বিষয়টি ছিল না উল্লেখ করে রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, এটি নতুন বিধিমালায় যুক্ত হয়েছে। শতভাগ নিয়মের মধ্যে থেকে ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখার কাজ শুরু হয়েছে এবং বহুতল ভবন মালিকদের এ সার্টিফিকেট নিতে বাধ্যও করা হবে। সার্টিফিকেট ছাড়া পরিষেবা সংযোগ না দেয়ার বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে রাজউক। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি আবু নাঈম বলেন, অনুমোদিত নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের কারণে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতিরও ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে বহুতল ভবনগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি একটু বেশিই। এছাড়া নির্মিত ভবনের সঙ্গে অনুমোদিত ভবনের নকশার মিল না থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ে।বহুতল ভবনগুলোর ব্যবহার সনদ না থাকার পাশাপাশি নেই ফায়ার এক্সিটও। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ২০১৭ সালে পরিচালিত এক জরিপে রাজধানীর অধিকাংশ বহুতল ভবনে ফায়ার এক্সিট না থাকার বিষয়টি উঠে আসে। ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তাদের ভবনে ফায়ার এক্সিট বা কোনো ধরনের বহির্গমন পথ নেই। কীভাবে ফায়ার এক্সিট ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে ধারণা নেই ৭৯ শতাংশের। ৭০ শতাংশ জানান, হঠাৎ কোনো দুর্যোগ হলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৯০ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন। এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকার বেশি। শুধু ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এসব ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১৩০ জনের। ২০১৮ সালে কেবল ঢাকা বিভাগেই ৬ হাজার ২০৮টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের বিষয়ে জানতে চেয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি বরং গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকলে বা অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ভবন সিলগালা করে দেয়া হবে। এ ছাড়া এসব ঘটনায় গাফিলতি কিংবা অস্বচ্ছতার প্রমাণ পাওয়া গেলে মালিক, ডেভেলপার, এমনকি রাজউকের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সবাইকে।