Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

অযত্ন-অবহেলায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে বড় কাটরা

প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ

এপ্রিল ১, ২০১৯, ০৭:৩০ পিএম


অযত্ন-অবহেলায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে বড় কাটরা

চারশ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যমণ্ডিত মোগল আমলের বড় কাটরা অযত্ন ও অবহেলায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির আশপাশ এলাকাঘুরে দেখা যায়, ভবনটির নিচে হোটেল, দোকানপাটসহ বিভিন্নভাবে স্থাপনাটি দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে ভবনটির চতুর্পাশ্বে উঁচু ভবন থাকায় বড় কাটরা এখন লোকচক্ষুর আড়ালে। মূল ভবনের ভিতরে নিজের মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে টিনশেড। এভাবেই ঐতিহ্যবাহী মোগল স্থাপত্য বড় কাটরার ভেতরে ও বাইরে দখলের কাজ চলছে। তাই প্রাচীন আমলের তৈরি করা পুরান ঢাকার চকবাজারের বড় কাটরা এখন হুমকির মুখে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নীতিমালায় বলা আছে, ঐতিহাসিক যেকোনো স্থাপনার আশপাশের ২৫০ মিটার এলাকা ‘বাফার জোন’ হিসাবে চিহ্নিত হবে। যেখানে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ভবনটির আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে উঁচু ভবনের প্রভাবে আড়ালে পড়ে গেছে ঐতিহাসিক এই নিদর্শন। ফলে এ নিদর্শন খুঁজে বের করতে ঐতিহ্যপ্রেমীদের বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।সরেজমিন দেখা গেছে, বড় কাটরার ভবনগুলোর অনেক জায়গায় চুন-সুরকি ব্যবহার না করে সিমেন্ট ও বালি দিয়ে প্ল্যাস্টার করা হয়েছে। আর ভবনটির তৃতীয় তলায় সিমেন্ট, বালি ও ইট দিয়ে নতুন নতুন ভবন তৈরি করা হয়েছে। ভবনটির পেছনেই গড়ে উঠেছে ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। যার মাঝে ফাঁকা কোনো জায়গা নেই। ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি ঘেঁষেই করা হয়েছে স্কুলটি। স্কুলটি এমনভাবে করা হয়েছে যে কারণে দক্ষিণ পাশের তোরণ দেখা যায় না। সুউচ্চ মধ্যবর্তী খিলানরূপী প্রবেশ তোরণযুক্ত ইমারতের নিদর্শন চিহ্নের ধ্বংসাবলির মধ্যে এই বড় কাটরাটির প্রকৃত কোনো অবয়ব চোখে পড়ে না। চার্লস ডি অয়েলির (১৮২৪-৩০) আঁকা স্কেচ থেকে ধারণা করা হয় যে, একসময় এই ইমারত বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত নিদর্শনরূপে ছিল। এখন তা কেবলই ইতিহাস। এ বিষয়ে আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, বড় কাটরা মূলত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবহেলার কারণেই তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। ১৯৮৯ সালে সংরক্ষণ করার জন্য তালিকাভুক্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। জায়গাটি এখন ৬০ ভাগই মাদ্রাসা ও মসজিদের দখলে। আর বাকি অংশে আবাসিক ভবন, কারখানা ও দোকানপাট করা হয়েছে।তিনি বলেন, বড় কাটরার অবস্থা নাজুক। এর ভেতরে-বাইরে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ঐতিহাসিক এই নিদর্শন সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। আমরাও এই নিদর্শন টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে আসলে কি হবে? অন্যরা কেউ এগিয়ে আসে না। তিনি ভবনটি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জানান। ২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে ৯৩টি ভবন ও চারটি এলাকাকে ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল। সেই গেজেটে বড় কাটরার কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে চকবাজারের মধ্যে থাকা সেই স্থাপনা এখনো সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি কাড়তে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত শতাধিক বছরের পুরনো স্থাপনাকে ঐতিহ্য সংরক্ষণের তালিকায় রাখা হয়। ওই তালিকাভুক্ত স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা গড়তে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে ঐতিহ্য সংরক্ষণের তালিকায় থাকা এসব স্থাপনা ভাঙতে হলে রাজউকের বিশেষ অনুমোদনের প্রয়োজন।২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাজউকের এক গেজেটে বলা হয়, ‘নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ব্যতীত তালিকাভুক্ত হেরিটেজ ভবন, স্থাপনা অপসারণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পুনঃনির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল।’ এবিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) রাখী রায় আমার সংবাদকে বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। সেটি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। আমরা সেটা অধিগ্রহণে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, স্থাপনাটি আমাদের অধীনে আসার পূর্ব থেকেই মাদরাসার দখলে আছে। এখানে একটি মাদরাসা রয়েছে সে কারণে একটু সময় লাগছে। তবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য আইন ২০০৪-এর খসড়া আইনের ১৮ ধারায় বলা আছে— ‘কোনো স্থাবর প্রত্নসম্পদ সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে (ভূমি মালিকানা যার থাকুক না কেন) তা ধ্বংস, ভাঙা, বিনষ্ট, পরিবর্তন, ক্ষতিসাধন করা হলে সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ স্থাপনাটিতে এখনো কেন বাফার জোন করা হয়নি এব্যাপারে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.শহিদুল্লাহ খন্দকার আমার সংবাদকে বলেন, ভবনটির পাশে এখনো কেন বাফার জোন করা হয়নি তা আমি রাজউককে জিজ্ঞাসা করবো।অন্যদিকে স্থাপনাটিতে অবস্থান করা জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটরা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাইফুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, জায়গাটি একটি ওয়াকফ সম্পত্তি। এটি মূলত হাফেজ হোসেন খান বাহাদুর ১৯৪৭ সালে এ জায়গাটিসহ পাশের আরও কিছু জায়গা মাদরাসার নামে ওয়াকফ করে দেন। তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে রেকর্ডীয় (বন্দোবস্ত) সূত্রে পেয়েছেন। আমরা সেই ওয়াকফ সম্পত্তিতেই আছি। এবং তা যেভাবে সংরক্ষণ করা লাগে আমরা এর সবটুকুই করছি। তবে বিভিন্ন জায়গায় সিমেন্ট বালু দিয়ে প্লাস্টার করার ব্যাপারটা তিনি শিকার করে বলেন এরকম কিছু হয়েছে। তা জরুরি কারণে করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে স্থাপনাটি যেভাবে সংরক্ষণ করা দরকার এর সবটুকু করার প্রতিশ্রুতি দেন।এ সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা মনে করেন, বড় কাটরা ঢাকা শহরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই স্থাপনাটি বাফার জোন করে ঐতিহ্য ঠিক রেখে সংরক্ষণ করার দাবি জানান। এখানে মাটির নিচে আরও ঐতিহ্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, তা খোদাই করে দেখার আহ্বান জানান। তারা দাবি জানান, স্থাপনাটির চারপাশ থেকে দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে। এবং এর চারপাশে থাকা বিভিন্ন বিল্ডিং ভেঙে পরিষ্কার করে স্থাপনাটি যেন দূর থেকে দেখা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা পদক্ষেপ নেবেন বলেও তারা আশা প্রকাশ করেন।