প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ
জুন ১৭, ২০১৯, ০৫:৪৮ এএম
চল্লিশ বছর ভিক্ষাবৃত্তি ও মানুষের ঘরে কাজ করে সংসার পরিচালনা করে ছেলে-মেয়েকে যোগ্য করলেও অন্তিম মুহূর্তে সেবা, খাদ্য, চিকিৎসা কিছুই মিলছে না শহরবানুর ভাগ্যে।
বুকভরা কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যদি জানতাম বৃদ্ধ অবস্থায় আমাকে এভাবে অযত্নে অবহেলায় পরে থাকতে হবে তাহলে যৌবনেই আরেকটি বিয়ে করে স্বামীর সংসারে চলে যেতাম। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সে কাজটি করিনি।
আজকে আমার সন্তানরাই... আর বলতে পারলেন না।’ কান্নায় চোখ ভিজে গেলো। বার্ধক্য প্রতিটি জীবেরই প্রাকৃতিক নিয়ম। বয়সের ভারে এক সময় নুয়ে পড়ে প্রতিটি জীবই। আর তখনই প্রয়োজন হয় সেবা, চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় খাদ্য।
প্রতিটি বাবা-মা আশা করে আদরের সন্তানরা বড় হয়ে খেয়াল রাখবে তাদের প্রতি। জন্মের পর বাবা-মা অনেক কষ্টের মাঝেও সন্তানকে ফেলে দেয় না। বরং আগলে রাখে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসে।
তাই বাবা-মা আশা রাখে তার সন্তানরাও সেভাবে আগলে রাখবে তাকে বৃদ্ধ বয়সে। কিন্তু সন্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেই বাবা-মার খবর নেয় না তখনই যেখানে সেখানে পড়ে থাকে মা-বাবার ভারসাম্যহীন দেহ। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে বা অন্যের কাছ থেকে চেয়ে খাবার মিলে তাদের।
এভাবেই বাঁচিয়ে রাখে তার ভারসাম্যহীন জীবন। এমনই এক বৃদ্ধের দেখা মিলেছে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পাশে জিনজিরা লায়ন কলোনির মাসুদ মিয়ার বাড়িতে। কথা বলে জানা যায় তার নাম শহর বানু। স্বামীর নাম মৃত মো. কেরামত আলী। তার স্বামী শহর বানুর বিবাহের ১৬তম বছরেই ইহজগৎ ত্যাগ করে। তার বয়স বর্তমানে ৮০ বছরের ওপরে। বৃদ্ধার স্বামী মৃত্যুর সময় আড়াই কাঠা বাড়ির জায়গা রেখে যান।
স্বামী মারা যাওয়ার পর তার স্বামীর রেখে যাওয়া চার সন্তানের মুখে এক মুঠো ভাত তোলে দিতে দিশাহারা হয়ে মানুষের দরজায়-দরজায় ভিক্ষা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি এই মা। একসময় ভিক্ষাবৃত্তি পেশা বন্ধ করে বাসাবাড়িতে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে।
নিজের পেটে আহার না দিয়ে সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃদ্ধার উপযুক্ত উপার্জনক্ষম সন্তান থাকলেও অনাহারে-অর্ধাহারে বিনাচিকিৎসায় মাটিতে পড়েই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকছেন। চার সন্তানের এই জননী গত চার বছর আগে বড় ছেলে ফজলু মিয়াকে (৫৫) হারিয়েছেন।
বড় ছেলের মৃত্যুর পর তার জীবনে চরম দুঃখ কষ্ট নেমে আসে। বৃদ্ধার দুই মেয়ে পারুল ও টিনা পৃথিবীতে থাকলেও তারা নিজ সংসার নিয়ে চরম ব্যস্ত। যে কারণে মায়ের খোঁজ নিতে তারাও সময় পায় না।
মেয়েদের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন মেয়েরা তাকে সেবা করেছেন। তবে গত দুবছর যাবত তাদের সংসারে ঝামেলা বাড়ার কারণে আর পারছেন না।
অন্যদিকে বৃদ্ধার কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ভাগ্যই ছিল এরকম। আমার শেষ জীবনে এরকম হবে এমন কিছু ভাবিনি। এসময় কান্না ভেজা কণ্ঠে তার জীবন-সংগ্রামের বর্ণনা দেন।
ভিক্ষা থেকে শুরু করে দোকানে পানি বিক্রি করা, মানুষের বাড়িতে কাজ করাসহ অনেক কাজ করতে হয়েছে তার সন্তানদের বড় করার জন্যে। অন্তিম মুহূর্তে এসে তিনি মনে করেন তার কপাল পোড়া, যে কারণে বৃদ্ধ বয়সেও তার ভাগ্যে বয়স্ক ভাতার একটি কার্ডও জোটেনি। আর কত বয়স অইলে বয়স্ক ভাতা পাবে, সেটাই তিনি জানতে চান সংশ্লিষ্টদের নিকট।
তিনি বলেন, ‘এক বেলা খাই আর দুই বেলা না খাইয়্যা থাহি, মাঝে মধ্যে সারাদিনেও কপালে এক লোকমা খাবার জোটে না। আমি বাইচ্যা আছি না মইরা গেছি কেউ খোঁজ নেয় না। মাইয়্যা জামাই নিয়া থাহে। ছেলে তার চার বউ নিয়া থাহে।’ বৃদ্ধা বলেন, ছেলের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
সে যেটুকু পারে সেটুকু দেখে। আমি তার জন্য দোয়া করি। ছেলেরা তার স্বামীর রেখে যাওয়া জমি বিক্রি করে দিয়েছে অনেক আগেই। পুত্র আব্দুল মান্নান চারটি বিয়ে করেছে বলে জানা গেছে।
চার বউকে লালনপালন করতে পারলেও মাকে একটু সেবা করার সুযোগ হয় না তার। আব্দুল মান্নানের ছোট বউ ও সন্তানরা খাটে থাকলেও মায়ের জায়গা হয়েছে মাটিতে। যেটুকু জায়গা তার জন্য বরাদ্দ রয়েছে সেটুকুতে ঠিকভাবে পা-ও মেলতে পারে না।
অল্প একটু জায়গায় অনাহারে-অর্ধাহারে পরে আছে এই বৃদ্ধা। প্রচণ্ড গরমে একটি পাখারও ব্যবস্থা রাখা হয়নি তার জন্য। এ ব্যাপারে তার পুত্র মান্নান বলেন, আমি পুরাতন কাপড়ের ব্যবসা করি। আমার পক্ষে যেটুকু দেখাশুনা করা সম্ভব হয় সেটুকু করছি। তবে এলাকাবাসী জানায়, সে ইচ্ছা করেই মায়ের লালনপালন বা সেবা করা থেকে বিরত থাকে।
এ ব্যাপারে মান্নানের চতুর্থ বধু আছমা বেগম বলেন, আমার স্বামী আমার কাছে নিয়মিত আসে না। আমি আমার শাশুড়িকে সাথে নিয়ে আছি। আমিও মানুষের বাসায় কাজ করে আমার তিন সন্তানকে লালনপালন করি।
সে কারণে মাকে যেটুকু দেখাশুনা করা দরকার সেটা করা সম্ভব হয় না। উনার চিকিৎসা ও খাওয়ার জন্য অনেক কষ্ট হয়। এ ব্যাপারে এলাকার বাসিন্দা বিলকিছ বেগম বলেন, মহিলার জন্য অনেক কষ্ট হয়।
পাশের ঘরে যখন ভালো কিছু রান্না হয় তখন তিনি খাবারের ঘ্রাণে অনেক কষ্ট পায়। তখন আমরা যা পারি তাকে দিয়ে আসি। এলাকার অন্য এক বাসিন্দা আজিজ মিয়া বলেন, তার চোখের পানি দেখে আমাদের খুব খারাপ লাগে। আমরা চাই সরকারিভাবে যেন তাকে খোঁজ নেয়া হয়।
এলাকার বাসিন্দা রমিজা বেগম (৩০) বলেন, তার পুত্রবধূ যদি ঘরে ভালো কিছু রান্না করেও তখন শাশুড়িকে না দিয়ে তার সন্তানদের অন্য ঘরে নিয়ে খাইয়ে দেয়। নিজের ঘরে খাওয়ালে বৃদ্ধা চাইবে সে কারণে অন্যের ঘরে নিয়ে খাওয়ায়।
এ ব্যাপারে জিনজিরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাকুর হোসেন বলেন, এই ব্যাপারটা আমার জানা ছিলো না। আমি খোঁজখবর নিয়ে দ্রুতই তাকে বয়স্কভাতা কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করবো। সরকার এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। আমরাও এ ব্যাপারে আন্তরিক।