Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

কুরআনের বিস্ময়কর আবিষ্কার বাংলাদেশের বিশ্বজয়

প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ

জুন ১৯, ২০১৯, ০৭:০২ পিএম


কুরআনের বিস্ময়কর আবিষ্কার বাংলাদেশের বিশ্বজয়

আবিষ্কার করতে কে না ভালোবাসে। সৃষ্টিশীল আবিষ্কার মানুষকে পৌঁছে দেয় অনন্যতায়। এনে দেয় খ্যাতি। আর আবিষ্কারের সুফল তো রয়েই যায় যুগ যুগ। কুরআনের এমনি এক আবিষ্কার করে পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছেন বাংলাদেশের একজন হাফেজ ও ক্বারি- শায়খ নেছার আহমাদ আন নাছিরী।

তার গবেষণার বিষয় ছিল কুরআনুল কারিমের ‘ওয়াকফ এবং ইবতিদাহ’। এ গবেষণা প্রকাশের পর থেকেই বাংলাদেশের হাফেজ শিশু-কিশোররা প্রতি বছর পৃথিবীর অসংখ্য দেশকে পেছনে ফেলে বিশ্বজয় করছেন। আনছেন অসামান্য পুরস্কার। হাফেজ নেছার আহমদ আন নাছিরী গবেষণায় বের করে এনেছেন এক নতুন কুরআন।

যা প্রচলিত কুরআন থেকে একটু ভিন্ন। যেখানে কোনো অক্ষর বা আয়াতের পরিবর্তন নেই। তবে নিয়ম-কানুনে এসেছে নতুনত্ব। যা পড়ে কুরআনের হাফেজরা বিশ্বজয়ে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছে। কুরআনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘তাহফিজ কুরআন শরিফ’। তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সালে মিসরের এক আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় হেমায়েতুল্লাহ নামের এক ছাত্রকে নিয়ে তিনি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

কিন্তু ওই প্রতিযোগিতায় হেমায়েত উল্লাহ নিয়মগত ভুল করলে বিচারকরা বাংলাদেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেন, অনারবরা কি কুরআন পড়বে? তাদেরকে এখানে পাঠিয়েছে কে? বিষয়টা তাকে খুব ব্যথিত করে। সে সময় তিনি চিন্তা করেন সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের মুখকে উজ্জ্বল করতে নতুন কিছু করার।

তখন থেকেই খুঁজতে থাকেন কেন বাংলাদেশি ছাত্ররা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে। শুরু করেন গবেষণা। সংগ্রহ করেন আরবি ভাষাভাষী দেশ থেকে তাদের ছাপা কুরআন। এছাড়াও কুরআনুল কারিমের নিয়ম-কানুন সংবলিত বিভিন্ন কিতাব। যা অধ্যয়ন করে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বশেষ ২০১২ সালে তিনি আবিষ্কার করেন সমস্যাগুলো।

তার গবেষণায় উঠে আসে কুরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্বজয়ের কলাকৌশল। গবেষণায় নতুন কি পেয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশি হাফেজদের বিশ্ব প্রতিযোগিতায় ভালো না করার অন্যতম কারণ হচ্ছে কোথায় থেকে তেলাওয়াত শুরু করবে, কোথায় গিয়ে শেষ করবে সেটি না জানা। আমি সেটি পুরো কুরআনুল কারিমে দেখিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে যে কুরআনুল কারিম চলে আসছে সেগুলিতে ভুল ছিল কিনা

এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, বাংলাদেশে যেসব কুরআন ছাপা হয়েছে তাদের ওয়াকফ এবং ইবতিদার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় ভুল ছিল। যে কারণে এভাবে কুরআন পড়ে তারা সফল হতে পারেননি।

শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, বাংলাদেশের হাফেজদের যখন আরব দেশে নিজের ইচ্ছায় কুরআনুল কারিমের কোনো জায়গা থেকে পড়তে বলা হয় তখন তারা পৃষ্ঠার শুরু থেকে পড়া আরম্ভ করে। এটাও অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়। কুরআনুল কারিম পড়ার নিয়ম হচ্ছে কোনো একটি ঘটনা যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখান থেকে শুরু করবে। এবং ঘটনা যেখানে শেষ সেখানে গিয়ে শেষ করতে হবে।

তার ছাপা কুরআনে বিশেষ চিহ্ন দ্বারা তা দেখিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে ছোট শিশুরা এটি বুঝতে পারে সহজেই। কুরআনে এমন অনেক আয়াত রয়েছে যা বিভিন্ন জায়গায় একই রকম। যাকে ‘মুশবাহাতুল আয়াত’ বা মুতাশাবিহাত বলা হয়ে থাকে।

বিশ্ব প্রতিযোগিতায় দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের যখন কুরআনের এক জায়গা থেকে প্রশ্ন করা হয় তখন সে একই রকম আয়াত হওয়ার কারণে পড়তে পড়তে অন্য এক আয়াতের সাথে গুলিয়ে ফেলে। সে কারণে কুরআনের কোন কোন জায়গায় একই ধরনের আয়াত রয়েছে তা তিনি একত্রিত করে কোথায় আছে তা পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লিখে দিয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীরা সহজেই খুঁজে বের করতে পারে একই রকম আয়াত।

গবেষণার ফলে কি ধরনের সফলতা পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৮ সালেও জর্ডানে ১৩তম আন্তর্জাতিক বালিকা কুরআন হেফজ ও কেরাত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের কিশোরী হাফেজ তাফরিহা বিনতে তাবারক অংশ নেন।

এর পূর্বে ২০১৭ সালে চমক সৃষ্টি করে বাংলাদেশের হাফেজরা। সে বছর বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে চারজন শীর্ষস্থানে উঠে আসেন। তাদের মধ্যে হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন সৌদি আরবের ‘বাদশা আবদুল আজিজ আল সৌদ আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় ৭৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

একই বছর দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ১০৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেন হাফেজ মুহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ১৫ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক রাজধানী দুবাইয়ে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাহরাইনে শায়েখ জুনায়েদ আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৫৪টি দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করে বাংলাদেশের কিশোর হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকি।

২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর কুয়েতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ৭২টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হয় সে। আন্তর্জাতিক কেরাত ও হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কৃতিত্ব অর্জনকারী আরেক বাংলাদেশি ক্ষুদ্র তারকার নাম হাফেজ ইয়াকুব হোসাইন তাজ।

২০১৭ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল জিম টিভির কেরাত ও হিফজ রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে ২৮টি দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে এ কিশোর। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী আরেকজন হাফেজের নাম আবু রায়হান। মার্চ ‘১৮-এ কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল জিম টিভির একটি রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে প্রথমস্থান অধিকার করে।

অনূর্ধ্ব পনেরো বছর বয়সিদের নিয়ে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কুরআন প্রতিযোগিতায় প্রথমস্থান অর্জনের পাশাপাশি কেরাত প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে। তাহফিজ কুরআন শরিফ প্রকাশের পর থেকেই বাংলাদেশের এমন সাফল্য বলে দাবি হাফেজদের। কুরআনের এই গবেষক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার যাত্রাপুর গ্রামে ১৯৮২ সালে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালে নিজ গ্রামেই তার পড়ালেখার হাতেখড়ি।

পরবর্তীতে কুরআনের উচ্চতর ডিগ্রির জন্য দেশ-বিদেশে পড়ালেখা করেছেন। দ্বীনের এই মহান ব্যক্তি ১৯৯৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জের চিলাকোট মাদ্রাসা থেকে তার শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতা শুরুর পর থেকেই বিশ্ব পরিমণ্ডল থেকে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা কিভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনবে তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই বিশ্ব পরিমণ্ডলে তাদের অবস্থান ভালো করা সম্ভব হচ্ছিল না।

গবেষণার পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫০ জনের উপরে পৃথিবীর প্রায় ১৪ টি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়ে আসেন। গত কয়েক বছর যাবত পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েদের দখলে। অনারব বলে তাচ্ছিল্য করা মিসর থেকেও এ পর্যন্ত ৩ জন বিজয়ী হয়েছে।

এছাড়াও কুরআনের সঠিক তিলাওয়াত শিখে প্রায় এ পর্যন্ত ইমাম হিসেবে কুয়েত ও কাতারে একশরও উপরে হাফেজ চাকরি পেয়েছেন। তিনি হেফজখানার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি চমৎকার সিলেবাস প্রস্তুত করেছেন। সিলেবাসটি হিফজ, নুরানি, নাজেরা ও জেনারেল শিক্ষার্থীদের জন্য উপকারী বলে দেশের আলেমদের অভিমত। সাথে সাথে বিদেশের বিখ্যাত অনেক হাফেজ ক্বারি ও আলেম ভিডিও বার্তার মাধ্যমে এ সিলেবাসের প্রশংসা করেছেন।

তারা মনে করেন কুরআনের হাফেজ হতে আগ্রহীদের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আধুনিক পদ্ধতিতে হিফজ শিক্ষার উপযোগী করে এমন সিলেবাস বাংলা ভাষায় এর আগে কেউ প্রকাশ করেনি।

ইতোমধ্যেই তিনি এই সিলেবাসের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তার প্রকাশিত সিলেবাস ফলো করে বিশ্বের ১০৩টি দেশের মধ্যে হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথমস্থান অর্জনসহ ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছেন।

সিলেবাস অনুযায়ী প্রকাশ হয়েছে চারটি বই। ১. তাহফিজ কুরআন ২. তাহফিজ কায়দা (৩ মাসের কোর্স) ৩. তাহফিজ আমপারা (৩ মাসের কোর্স) ৪. তাহফিজ তথ্য বই (দৈনিক পড়ার হিসাব নিকাশ)। তাহফিজ আমপারায় ত্বাকতি, আলফাজ ও কুরআনের আয়াতের ওপর সিলেবাসভিত্তিক বর্ণনা রয়েছে। ত্বাকতি হচ্ছে আমপারায় স্থান পাওয়া সুরাগুলোর প্রতিটি আয়াতকে অক্ষর করে পৃথকভাবে দেখানো হয়েছে।

এতে করে যে কোনো উচ্চারণ সহজভাবে করা যাবে। সূরাতুল ফাতিহা থেকে নাস ও সূরা ফিল পর্যন্ত এখানে স্থান পেয়েছে। আলফাজ বা শব্দ সমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে সূরা হুমাজাহ থেকে সুরা দোহা পর্যন্ত সূরাগুলোর প্রতিটি আয়াতকে পৃথকভাবে দেখানো হয়েছে। তাহফিজ আমপারার শুরুতেই কুরআন তেলাওয়াতের আদব ও মাসনুন দোয়াসমূহ সুবিন্যস্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ওয়াকফের বিবরণ ও ইবতেদার গুরুত্ব এবং ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে আমপারার শুরুর দিকে।

আরবি ভাষা ও কুরআন শরিফ তেলাওয়াত যারা শিখতে চান তাদের জন্য তাহফিজ কায়দা এক অনন্য কিতাব। মাখরাজ সিফাতের চিত্রসহ সিলেবাসভিত্তিক এ কায়দা গ্রন্থে হরফ মাখরাজ নুকতা মুরাক্কাব তাশদিদের সাথে জরুরি দোয়া ও মাসয়ালা তুলে ধরা হয়েছে। তাহফিজ তথ্য বই একটি দৈনন্দিন ডায়রি। হিফজুল কুরআনের শিক্ষার্থীদের পাঠোন্নতির জন্য এ বই। প্রতিদিনের পাঠ ছক আকারে লিপিবদ্ধ করার জন্য এ পদ্ধতি দেয়া হয়েছে।

যা আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির এক নতুন সংযোজন। মারকাজুত তাহফিজ ফাউন্ডেশন নামক সংস্থা এ চারটি কিতাবের প্রকাশক। এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী, আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীসহ বিশিষ্ট আলেমরা বর্তমান সময়ের যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন।