Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রতারণার জাল তালাকেও

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

জুন ২১, ২০১৯, ০৬:৪৩ পিএম


প্রতারণার জাল তালাকেও

*৫২ বছর আগে বাতিল হওয়া আইনেও হচ্ছে তালাক
*ভুয়া তালাকনামায় একাধিক বিয়ের চর্চা
*তালাকের পরও ১১ বছর সংসার
*স্বামীকে তালাক দিয়েও জানেন না স্ত্রী
*ভুয়া তালাকে সামাজিক বিভ্রান্তির শঙ্কা
*যৌতুক আদায়েও ভূমিকা রাখছে ভুয়া তালাক

সংগত কারণে মুসলিম স্বামী বা স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। তবে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করতে হলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নও করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আইনের তোয়াক্কা করছে না জালিয়াতমনা দুষ্টু প্রকৃতির নারী-পুরুষরা।

আইনের ব্যতয় ঘটিয়ে সামাজিক বিপত্তি সৃষ্টি করেই তালাক প্রক্রিয়ায় জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে একটি পক্ষ। অথচ তালাক প্রক্রিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম প্রক্রিয়া— তালাকের নোটিস পাঠানোর বেলায় যেসসব বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তাও মানছে না অনেকেই।

নোটিসের পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলোতেও নিয়মের যথাযথ বাস্তবায়ন না করায় তালাক কার্যকরে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। তালাকের নোটিস কার্যকরে যথাযথ পদ্ধতি না মানলে আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে- শাস্তির বিষয়টিও উপেক্ষা করেই জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে তালাকনামা।

এতোসব আইনের তোয়াক্কা না করেই জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট তালাকনামা নিয়ে সম্প্রতি প্রতারণার বহু ঘটনা গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা গেছে। তার মধ্যে খোদ রাজধানীতেই ঘটেছে দুটি বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা।

যাত্রাবাড়ী ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সম্প্রতি জালিয়াতির দুইটি ঘটনার খবর পাওয়া যায়। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রেহেনা বেগম নামের এক নারী দেলোয়ার হোসেন নামে অবিবাহিত পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরের (এসআই) সঙ্গে বিধবা উল্লেখ করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

কাবিন রেজিস্ট্রির মাধ্যমেই দাম্পত্য জীবনেবর শুরু করলেও দীর্ঘদিন পর দেলোয়ার হোসেন জানতে পারেন তার বিবাহিত স্ত্রী বিধবা নয় বরং পূর্বের স্বামীর সঙ্গে ছেলে-মেয়েসহ বর্তমানেও দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন। অথচ সম্পূর্ণ বিষয়টি গোপন রেখেছেন রেহেনা বেগম।

বিষয়টি জানাজানি হলে- রেহেনা বেগম তার পূর্বের স্বামী নাছির উদ্দিন বাদলকে তালাক দিয়েছেন উল্লেখ করে তালাকের একটি কপিও উপস্থাপন করেন।

দেলোয়ার হোসেন তালাকনামাটি নিয়ে কেরানীগঞ্জের সংশ্লিষ্ট কাজী অফিসে যোগাযোগ করলে রেজিস্ট্রি বইয়ে এর কোনো অস্তিত্ব নেই জানিয়ে তালাকনামাটি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রত্যয়নপত্রও দেন।

প্রত্যয়নপত্রটি রেহেনা বেগমকে দেখালে এবং এ সংক্রান্ত্রে কৈফিয়ত জানতে চাইলেই বেরিয়ে আসে ওই নারীর হিংস্র রূপ। হুমকি-ধমকি বৈকি পরপর চারটি মামলা দেনও দেলোয়ারের নামে। পুলিশ সদর দপ্তরেও অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে করিয়েছেন বিভাগীয় তদন্ত।

হিংস্র এ নারীর পূর্বের স্বামীকে তালাক দেয়ার নামে ভুয়া তালাকনামার মাধ্যমে বিষিয়ে তুলেছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তার জীবন। পূর্বের স্বামী নাছির উদ্দিন বাদলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কোনোকালেই তালাক হয়নি।

আমরা বিয়ের পর থেকে এখনো স্বাভাবিকভাবেই সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। তবে দেলোয়ার হোসেনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি ওরা দুইজন সম্পর্কে ভাইবোন। এসআই দেলোয়ার বলেন, রেহেনা বেগম তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এবং এ জন্য রেহেনা বেগম তাকে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করেছেন।

সম্প্রতি যাত্রাবাড়ী এলাকার ঘটনার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়- স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিয়েছেন, কিন্তু স্ত্রী নিজেই তা জানেন না। অথচ মাত্র ১২ বছর বয়সেই খালাতো ভাইয়ের (স্বামী সোহেল মিয়া) সঙ্গে বিয়ে হয় শিউলি আক্তার কনা (স্ত্রী) নামের ভুক্তভোগী ওই নারীর। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তার।

স্বামী মো. সোহেল মিয়া যাত্রাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী। ২০ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের একটি ছেলেও রয়েছে। ছেলেটি বর্তমানে স্থানীয় একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। বিয়ের ২০ বছর পর চলতি মাসের ৪ জুন কনার জীবনে নেমে আসে কাল বৈশাখী ঝড়।

তোমার আর তোমার ছেলের কোনো খরচ আমি দিতে পারবো না। কারণ তুমি আমাকে তালাক দিয়েছো- স্বামীর এমন বক্তব্যে নির্বাক কনাকে ওইদিনই প্রকাশ্যে রাস্তায় মারধরও করে সোহেল। সে সময় চিৎকার করে বারবার বলছিলো কনা, আমি তো তোমাকে ডিভোর্স দেই নাই।

কবে তোমাকে ডিভোর্স দিলাম! আমি তোমাকে ডিভোর্স দিলাম আর আমিই নিজেই জানি না! জবাবে সোহেল মিয়া বলেন, তুমিই আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো, আমার কাছে প্রমাণ আছে। চাইলে তোমাকে দেখাতে পারি।

পরে এই ডিভোর্সসংক্রান্ত একটি কাগজও দেখিয়েছেন কনার স্বামী সোহেল। যেখানে বলা আছে— ১১ বছর আগে তার স্ত্রী শিউলী আক্তার কনা স্বেচ্ছায় তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। তবে স্থানীয় কাজী অফিসে খোঁজ নিয়ে প্রাথমিকভাবে ওই কাগজের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এভাবেই স্বামীর চরম জালিয়াতির শিকার হয়েছেন শিউলি আক্তার কনা নামে ওই নারী। ভুয়া ডিভোর্সনামা তৈরি করে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তার স্বামী সোহেল মিয়া। পুলিশ বলছে, ওই নারীর দায়ের করা মামলায় তার স্বামীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। বর্তমানে স্বামী সোহেল কারান্তরীণ রয়েছেন।

চলতি বছরের মার্চেও বরগুনাতেও তালাক জালিয়াতির একটি ঘটনা ঘটে। যে ঘটনায় দেখা যায়, তালাক দিয়েও তা গোপন রেখে স্ত্রীর সঙ্গে সংসার চালিয়ে যান স্বামী। তালাকের পরও প্রায় আট মাস পর স্ত্রী বর্ষা মনি একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। জানা গেছে, বর্ষা মনির বাবা সুদূর মরিশাস প্রবাসী ছিলেন।

বর্ষা মনি ও তার স্বামী সবুজ ওরফে আকাশ সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। প্রেমের সম্পর্কের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও যৌতুকে কাছে হার মানে পারিবারিক সম্পর্ক। মরিশাস থেকে পাঠানো বর্ষা মনির বাবার ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই তালাকের বিষয়টি গোপন রেখেছিল আকাশের পরিবার।

বর্ষা মনি গণমাধ্যমে এমনটি জানিয়ে বলেন, সন্তান হওয়ার পরই তাদের বিরক্তিবোধের কারণে আমার সন্দেহ হয়। সন্দেহের জেরে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারাই বিষয়টি স্বীকার করে।

২০১৩ সালে চট্টগ্রামের ঘটে এমন একটি ঘটনা। যে ঘটনায় জানা যায়, যৌতুকের মামলা থেকে রক্ষা পেতে ১৯৬১ সালে বাতিল হয়ে যাওয়া আইনে স্ত্রীকে তালাক দেখিয়েছিলেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার খায়াংখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম।

পরে ওই তালাকনামা ভুয়া প্রমাণিত হলে নজরুল এবং কক্সবাজারের রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নের কাজি মুহাম্মদ তৌহিদুলকে কারাগারে প্রেরণ করে আদালত। নজরুলের স্ত্রী নাহিদা নাসরিনের আনা অভিযোগের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম নূরে আলম ভূঁইয়া তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আরজিতে নাহিদা নাসরিন অভিযোগ করেন, নজরুল আদালতে যে তালাকনামা দাখিল করেছেন তাতে বেঙ্গল মুসলিম ফ্যামিলি ল-এর কথা বলা আছে, যা ১৯৬১ সালে বাতিল হয়ে যায়।

ঘটনার ৫২ বছর পূর্বে বাতিল হয়ে যাওয়া আইনে রশিদনগর ইউনিয়নের কাজি মুহাম্মদ তৌহিদুল ভুয়া তালাকনামাটি তৈরি করে দেন। এরপর তা তার কাছে পাঠান নজরুল ইসলাম। এতে তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে বলে আরজিতে উল্লেখ করা হয়।