প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ
জুলাই ৬, ২০১৯, ১১:৩৮ পিএম
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন না করে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে দীর্ঘদিন বিরোধ থাকলেও গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীন ‘কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল, ২০১৮’ পাস হয়।
সরকারের কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এ স্বীকৃতি দেয়া ঠিক হবে না মর্মে শিক্ষাবিদদের সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন গোপনে দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হয়ে পাস করার মধ্য দিয়ে আবারো তা সামনে আসে।
সমালোচনার বিষয় নিয়ে শিক্ষাবিদদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান নিয়ে বেশ কথা রয়েছে।
তারা বলেন, মাস্টার্সের সমমান নিয়ে দুটি বিষয়কে যদি আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাই কওমির সর্বোচ্চ এই স্তরে মূলত হাদিসের প্রধান ছয়টি গ্রন্থ (সিহাহ সিত্তা) এবং হাদিস-সংক্রান্ত আরও দুটি কোর্স পড়ানো হয়।
মূলত হাদিস হলেও এর ভেতরে কুরআনের বিভিন্ন অংশের তাফসির, ফিকাহও চলে আসে। কোর্সটি এক বছরের।
সমমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর সিলেবাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই সেমিস্টার মিলে ১০টি বিষয় শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়।
এখানে পবিত্র কুরআনের তাফসির, উলুমুল কুরআন (সায়েন্স অব দ্য কুরআন) ও হাদিস শরিফের বাইরে ‘টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ মেথোডলজি’ এবং ‘ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড ফিলোসফি অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড কমপ্যারেটিভ রিলিজিয়ন’ নামে দুটি কোর্স পড়ানো হয়।
যা কওমি মাদ্রাসায় নেই। অন্যদিকে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ড. মোবারক হোসাইনের ব্যাপারে জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসার নিয়মিত ছাত্র না হয়েও দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ‘মাওলানা’ ডিগ্রি পেলেন শিবির সভাপতি।
অত্যন্ত গোপনে পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। ফলাফল প্রকাশের পর এটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।
দাবি উঠেছে, দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য সব স্তরের সনদ ও কওমি মাদ্রাসার নিয়মতান্ত্রিক ছাত্রত্ব থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল)-এ ৬৯৬ নম্বর পেয়ে জায়্যিদ জিদ্দান (প্রথম বিভাগ) বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
‘আল হাইআতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে অনুষ্ঠিত ১৪৪০ হিজরি শিক্ষাবর্ষের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) পরীক্ষায় তিনি এ ফলাফল অর্জন করেন।
দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম বিভাগ পাওয়ার খবর শিবির সভাপতি তার ফেসবুক পেজে জানান।
এরপরই সব মহলে সমালোচনার ঝড় উঠে। জানা গেছে, তিনি আল জামিয়াতুল উসমানিয়া দারুল উলুম, সাতাইশ, টঙ্গি মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। আর পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল টঙ্গীর চেরাগ আলীতে অবস্থিত দারুল উলুম মাদ্রাসা।
মোবারক হোসাইনের রোল নম্বর ৬৯৪৫। এ বিষয়ে বেফাকুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর সদস্য ফরিদ উদ্দিন মাসউদ আমার সংবাদকে বলেন, শিবির সভাপতি এভাবে ভর্তি হয়ে প্রতারণা করেছেন।
অন্যদিকে যে মাদ্রাসা ভর্তি নিয়েছে তারাও অন্যায় করেছে। তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ এরকম অন্যায় আর না করতে পারে।
শিবির সভাপতি কীভাবে সাতাইশ মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষার সুযোগ পেলেন— এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষক বলেন, ঘটনা সত্য।
শিবির সভাপতি আমাদের মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। তবে তিনি আমাদের মাদ্রাসায় ভর্তি হননি। ক্লাস করেছেন।
যাকে বলা হয়, ‘সেমায়াত’। মাদ্রাসার বোখারির শিক্ষক মাওলানা আবদুল মতিনের সুপারিশে তাকে এ সুযোগ দেয়া হয়। আমরা এর পক্ষে ছিলাম না।
এ বিষয়ে মাওলানা আবদুল মতিন বলেন, আমি তাকে সেভাবে চিনি না। আমাকে অন্য একজন বলেছে তিনি প্রফেসর। তাই আমি তাকে দ্বীন শিখার সুযোগ করে দিয়েছি।
এ বিষয়ে আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর সদস্য ও জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, এটা অন্যায় সেটা বলতে অসুবিধা নেই। তবে যেহেতু আমাদের এই বোর্ডের যাত্রাটা নতুন সেহেতু কিছু ভুল আছে। আমরা সেটা নিয়ে চিন্তা করতেছি।
ভবিষ্যতে যেন এরকম ভুল আর কেউ না করার সুযোগ পায় সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। কওমি মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, অনেক মাদ্রাসা তাদের ছাত্র সংখ্যা বেশি দেখানোর বাসনায় অনিয়মিত ছাত্রদের পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেন।
আর এই সুযোগটি নিয়েছেন শিবির সভাপতি। অথচ তিনি কওমি মাদ্রাসার ছাত্র নন, তার আকিদা-বিশ্বাস উলামায়ে দেওবন্দ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা পরিপন্থী। তারপরও তিনি দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট গ্রহণের সুযোগ নিলেন।
অন্যদিকে এ দাওরায়ে হাদিসের সনদের মান নিয়ে শিক্ষাবিদরা আবারো কথা তুলেছেন। তারা মনে করছেন সুস্পষ্ট নীতিমালা না করে এভাবে চলতে দেয়া যায় না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সুতরাং তাদেরকেও ভর্তির জন্য কিছু নীতিমালা প্রস্তুত করা দরকার। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র এভাবে ভর্তি হতে পারে না।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়ের সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকার যেহেতু তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং তাদের জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা করে দেয়া দরকার।
যাতে করে এ ধরনের কাজ না হয়। একটি ছাত্র কোথা থেকে এলো কিভাবে এলো সেটা না জেনে কাগজপত্র না দেখে ভর্তি করলে তো হবে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।