Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫,

চলছে মিথ্যা মামলার বেসাতি

প্রিন্ট সংস্করণ॥শরিফ রুবেল

জানুয়ারি ৩০, ২০২০, ০৬:৫০ পিএম


চলছে মিথ্যা মামলার বেসাতি মিথ্যা মামলা ও সাক্ষ্য প্রদান। আইনগতভাবে দুটোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে সহজেই বিপর্যস্ত হয়ে যায় মানুষের জীবন। অথচ বর্তমানে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই মিথ্যা মামলাকেই। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেকেই মিথ্যা মামলা দায়ের করে থাকে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে প্রতিপক্ষকে প্রায়ই সামাজিক এবং আর্থিকভাবে হয়রানি করার ঘটনা ঘটাতে দেখা যায়। শুধু মিথ্যা মামলা ঢুকেই ক্ষান্ত হয় না মামলাবাজ চক্র, তাদের কার্যসিদ্ধির জন্য আদালতে আবার মিথ্যা সাক্ষ্যও উপস্থাপন করা হয়। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের যথেচ্ছা ব্যবহারই বাড়াচ্ছে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘মিথ্যা মামলা’র হার। ফৌজদারি কার্যবিধিতে এক সময় মামলা করার আগে যাচাই-বাছাইয়ের বিধান থাকলেও সেটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এখন যেকোনো ব্যক্তি যে কারো বিরুদ্ধে ঠুকে দিতে পারছে মামলা। পরে এ মামলা ‘মিথ্যা’ ও ‘উদ্দেশ্যমূলক’ প্রমাণিত হলেও মামলার প্রতিপক্ষ ফেরত পান না তার ভোগান্তি ও ব্যয়িত অর্থ। মানুষ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আগের তুলনায় বতর্মানে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই আদালতমুখী হয়েছে। যার ফলে প্রতিদিন আদালতেও বিভিন্ন বিষয়ে হচ্ছে প্রচুর মামলা। আর এসব ক্ষেত্রে আদালতে মামলা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী অপরিহার্য। সাক্ষ্য ছাড়া বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেন না। একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশের আদালতগুলোতে অন্তত ৩৭ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ২০ লাখের বেশি ফৌজদারি মামলা। আর এসব মামলার ৯০ ভাগই শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক, মিথ্যা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। জানা যায়, পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করেই মূলত সবচেয়ে বেশি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। যেমন যৌতুক, ভরণপোষণ, খোরপোশ, তালাকের মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রায় ৮০ শতাংশ মিথ্যা মামলা হয়। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের অমতে প্রেমের বিয়েকে কেন্দ্র করে নারী অপহরণ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়। নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক উদ্দেশ্যে দায়ের করার ঘটনা ঘটে। এদিকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে মিথ্যা মামলার শিকার হলে আইন অনুযায়ী মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধানও রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেকোনো মামলা নেয়ার সময় থানা বা আদালতের উচিত প্রাথমিক একটা তদন্ত করা। তদন্ত ছাড়া মামলা হলে এটা নকল মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কোনো ব্যক্তি থানায় মামলা করতে গেলেন আর থানা মামলা নিয়ে নিলো এমন হওয়া যাবে না, এক্ষেত্রে থানা প্রশাসনের আরও সচেতন হতে হবে। আর প্রশাসন সচেতন বা তারা এর সাথে জড়িত না থাকলেই মিথ্যা মামলা রোধ করা সম্ভব। এবং প্রশাসনের উচিত অতিদ্রুত এসব মামলাবাজ সিন্ডিকেটকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা। তাদের দাবি, বিভিন্ন সময় এমন মামলার কথা শোনা গেলেও দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা যায়নি বলেই দিন দিন এই চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, এসব ভুতুড়ে মামলার সংসৃ্কতি চালু হয়েছে বলেই মামলাবাজ চক্র এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।মিথ্যা মামলার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর জেল খেটে কারাগার থেকে বের হয় রাজধানীর টিকাটুলীর এম সাইফুল্লাহ। ৬০-এর অধিক মামলা নিয়ে পনেরো বছরে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন সাইফুল্লাহ। তার নামে মামলা হয়েছে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের প্রায় ১০টি জেলায়। কিন্তু কে বা কারা সাইফুল্লাহর নামে এসব মামলা করেছেন সেটা জানা নেই তার। মামলার বাদিকেও চিনেন না সাইফুল্লাহ। সূত্র মতে, বর্তমানে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের প্রবণতায় যুক্ত রয়েছে থানা পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো বেশকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি দমন কমিশন ওয়ান-ইলেভেনের পর অন্তত আড়াইশ মামলা দায়ের করে। যা পরে উচ্চ আদালতে মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে মর্মে বাতিল হয়ে যায়। এমনকি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব গায়েবি ভুতুড়ে মামলা হয়েছে সেটাও বিচারিক আদালত বা উচ্চ আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আলোচিত পাটকল শ্রমিক জাহালমের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত ৩৬টি ভুয়া মামলা হয়। এনবিআর দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলাই উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। এসময় প্রচলিত আইনের বিভিন্ন ধারায় দায়েরকৃত মামলার মধ্যে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় অন্তত ১০ হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। মিথ্যা মামলা দিয়ে বাদির কারাভোগ : ক্ষেত্রবিশেষ এসব মিথ্যা মামলা দায়েরকারীদের মাঝেমধ্যে শাস্তি ভোগ করতে হয়। তেমনই একটি মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে এবং জাল জখমী সনদ দাখিল করে মামলা করায় বাদি মোসলেহ উদ্দিন মিন্টুকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছে নোয়াখালীর একটি আদালত। একইসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। গত বুধবার নোয়াখালী জেলার অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী এ রায় ঘোষণা করেন। ঘটনার বিবরণ থেকে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৭ আগস্ট মোসলেহ উদ্দিন মিন্টু নামের এক ব্যক্তি মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে ও জাল জখমী সনদ দাখিল করে নোয়াখালী জেলার চরজব্বার থানায় আসামি আবুল কাশেমসহ মোট আটজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত জাল জখমী সনদের ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার সাক্ষ্যপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বাদি ও ভিকটিম মো. মোসলেহ উদ্দিন মিন্টু হাসপাতালে ভর্তি হননি এবং জখমী সনদ সৃজিত (জাল) মর্মে আদালতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন দাখিল করেন। বারবার প্রসেস প্রেরণ করার পরও তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাদি সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালতে উপস্থিত হননি। এমতাবস্থায় বাদিকে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেন আদালত। অবশেষে গতকাল বাদির অনুপস্থিতিতে আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী বাদিকে আসামিদের বরাবর ১০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন। ক্ষতিপূরণ অনাদায়ে তাকে ১০ (দশ) দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। একইসঙ্গে বাদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০(৫) ধারায় আরও অতিরিক্ত ১৫ (পনেরো) দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। পাশাপাশি মামলার ঘটনায় আসামিদের সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনায় আসামিদের সম্পৃক্ত করে এবং জখমী সনদের সত্যতা যাচাই না করে জাল জখমী সনদের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দাখিল করায় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. রবিউল ইসলাম, চরজব্বার থানা, নোয়াখালীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। রায়ের কপি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হয়। এছাড়া মামলায় গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণে আনীত অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়। মিথ্যা মামলা ও সাক্ষ্য প্রদানে যে শাস্তি হবে : বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধান বাংলাদেশের জনগণকে এই অধিকার দিয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারায় মিথ্যা অভিযোগের শাস্তির বিধান রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদিকে কারণ দর্শানোর নোটিসসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। দণ্ডবিধির ১৯১ ও ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তির জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। দণ্ডবিধির ২০৯ ধারামতে, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। আবার ২১১ ধারায় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে কোনো অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে মর্মে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান রয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয় যদি এমন হয় যে যার কারণে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা সাত বছরের বেশি সাজা হওয়ার আশঙ্কা ছিলো, তাহলে দায়ী অভিযোগকারীর সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭ ধারায়ও মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারো ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা করার জন্য আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন অথবা করান, তবে সেই অভিযোগকারী অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। মিথ্যা মামলা কিভাবে হ্রাস করা যায় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আমার সংবাদকে বলেন, মিথ্যা মামলা একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কারণ অনেক সময় মিথ্যা মামলায় অনেক ভুক্তভোগীকে পাঁচ থেকে ১০ বছরের সাজা হয় বা সাজা খাটার নজির রয়েছে। এতে ভুক্তভোগীর ধ্বংস হওয়ার আর বাকি থাকে না। তাই অবশ্যই যেকোনো অভিযোগ আগে খতিয়ে দেখে মামলা গ্রহণ করলে এমন ঝুঁকি থাকে না। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রশাসনের খুব সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান আমার সংবাদকে বলেন, যেকোনো মামলা করার সময় থানা বা আদালতের উভয়েরই আইডেন্টিফিকেশন করে তবেই সেটা গ্রহণ করা উচিত। যদি মামলা নেয়ার আগে একটা প্রাথমিক তদন্ত করা হয় তাহলে পুলিশ সহজেই নকল মামলা শনাক্ত করতে সক্ষম হবে। আর যদি মিথ্যা মামলা ধরা পড়ে যায় তাহলে ওই থানায় আর এ ধরনের মামলা করার কেউ সাহস পাবে না বা পুলিশেরও বিষয়টি মাথায় থাকবে। অনেক সময় দেখা যায়, অপহরণ ও ধর্ষণের মামলাগুলো হওয়ার পরই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়, এতে কোনো রকম তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয় না। ফলে মিথ্যা মামলার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে আসামিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমারসংবাদ/এসটিএমএ