Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ঝুলছে অর্পিত সম্পত্তির মামলা

শরিফ রুবেল

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০, ০৫:৩১ এএম


ঝুলছে অর্পিত সম্পত্তির মামলা
  • সারা দেশে ৮৮ হাজার ৮৮২টি মামলা বিচারাধীন
  • ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত
  • সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে বাধা আইন মন্ত্রণালয়ের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি দাবি বিশেষজ্ঞদের
  • পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে ৬৬ হাজার মামলা

অর্পিত সম্পত্তি। সারা দেশের অসংখ্য মানুষ বছরের পর বছর সম্পত্তি ফেরত পেতে মামলা করেও অসহনীয় হয়রানি ও দুর্ভোগের মধ্যে আছেন। অনেককে বংশপরম্পরায় ঘুরতে হচ্ছে একই মামলার পেছনে। তেমনই একজন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার শুকান্ত চন্দ্র রায়। পিতা বিমল চন্দ্র মারা যাওয়ার পর ওয়ারিশসূত্রে পিতার রেখে যাওয়া ৮০ শতাংশ সম্পত্তি তিনিই ভোগ দখল করে আসছিলেন।

কিন্তু বিপত্তি ঘটে ২০০৬ সালের ৩ জানুয়ারি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ওই সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত হয় অর্পিত সম্পত্তির ‘ক’ তফসিলে। নিজ সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ায় হতাশা নিয়ে দীর্ঘদিন ঘুরছেন রাজবাড়ী প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। তবুও কোনো কিনারা করতে পারছেন না ভুক্তভোগী শুকান্ত চন্দ্র। সম্পত্তি অবমুক্ত করার জন্য মামলা করেছিলেন ২০০৬ সালে। মামলা নং ১৫৫/২০০৬।

এখনো বিচারধীন রয়েছে এই মামলা। কত বছরে এর বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে সেটা নিয়েও ধোয়াসা দেখছেন শুকান্ত। দেশ ভাগ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে এসব সম্পত্তি ফিরে পেতে শুরু করেন আইনি লড়াই।

জানা যায়, ২০০১ সালে প্রণীত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের ১০ ধারায় ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান আছে। আবার গত বছর ২০১৮ সালের এপ্রিল হাইকোর্টও এক রায়ে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন।

কিন্তু আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশ সবই উপেক্ষিত থাকছে। এখনো এর কোনো কার্যকর বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি এক থেকে দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না অর্পিত সম্পত্তির মামলাগুলো।

আইনসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্পিত সম্পত্তির ছয় দফা সংশোধনের পরও সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে বাধা কাটছে না বলেই এর জটলা দিনদিন আরও প্রকট হচ্ছে।

এর জন্য দায়ী ভূমি মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি। তাদের মত, যেহেতু অর্পিত সম্পত্তি একটা বড় সেক্টর তাই এটাকে পুঁজি করে ঘুষবাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে জেলা প্রশাসক (ডিসি), এসিল্যান্ড এবং তহসিলদার চক্র এই সমস্যা জিইয়ে রাখছে।

এদিকে অর্পিত সম্পত্তির বেড়াজালে আটকে থাকা ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ৫৪ বছর ধরে আইনটি নিয়ে খেলছে সরকার। লিজ নেয়ার নামে যারা এই সম্পত্তি ভোগ করছেন তারা বেশিরভাগই রাজনৈতিক সুবিধাভোগী।

ফলে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। একে তো মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি, তার উপর রায় বাস্তবায়নে আরও ধীরগতি তাদের হতাশ করছে। আদতে তারা সেই সম্পত্তি ভোগদখল করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

এছাড়া ভুক্তভোগী শুকান্তের অভিযোগ— তার মামলা নিয়ে সরকার পক্ষের আইনজীবীর কোনো আগ্রহ নেই। কারণ এখানে আর্থিক লেনদেন নেই। মামলাকারীর পক্ষ থেকে সরকার পক্ষের আইনজীবীকে টাকা দিয়ে মামলার তারিখ নিতে হয়।

আদালত সূত্রে জানা যায়, সারা দেশের আদালতগুলোতে অর্পিত সম্পত্তির ৮৮ হাজার ৮৮২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে ৬৬ হাজার মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।

এসব মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জমির পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯৩১ দশমিক ৯১ একর। এরমধ্যে বাতিল করা ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির পরিমাণ সাত লাখ ৫১ হাজার ৫৮৯ দশমিক ২২ একর।

এদিকে বিগত ৫ বছরে বাতিল করা ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে তিন লাখ ৮৩ হাজার ১৪টি আবেদন পড়েছে। ২০১৩ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন কার্যকর হওয়ার পর মোট ১ লাখ ৮১ হাজার ৭০ দশমিক শূন্য ২ একর ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘ক’ তফসিল সংক্রান্ত ২৩ হাজার ৩০১ দশমিক ৩৬ একর জমির মামলা ট্র্যাইব্যুনালে রায় হয়েছে।

যার মধ্যে ১০ হাজার ২৫৫ দশমিক ১৫ একরের রায় ব্যক্তির পক্ষে এবং ১৩ হাজার ৪৬ দশমিক ২২ সরকার পক্ষে রায় হয়েছে। এছাড়া ‘খ’ তফসিলে এক লাখ ৫৭ হাজার ৭৬৮ দশমিক ৬৬ একর ভূমির রেকর্ড সংশোধন হয়েছে।

যার মধ্যে ব্যক্তি পক্ষে গেছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৭৫২ দশমিক ১৫ একর আর সরকারের পক্ষে গেছে দুই হাজার ১৫ দশমিক ৮৬ একর। এই ২ হাজার ১৫ দশমিক ৮৬ একর জমি মূলত ‘স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০’-এর বিধান অনুসারে খাস খতিয়ানভুক্ত হয়েছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ সোয়া দুই লাখ একরের মতো। এগুলো প্রত্যর্পণের জন্য বিভিন্ন আদালতে আবেদন পড়েছে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখের মতো।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গড়ে দুই থেকে তিন শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হতো।

নির্বাচনের পর ১৯টি জেলার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিষ্পত্তির এই হার বেড়ে হয়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। কিন্তু প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে এই হার খুবই কম। এই হার মাত্র পাঁচ থেকে সাত শতাংশ।

জানা যায়, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস-১৯৬৫’ অনুসারে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ‘শত্রু সম্পত্তির’ নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ রাখা হয়।

অর্পিত সম্পত্তি মূল মালিক বা তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সেই বিষয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগ ছিলো না।

আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে নতুন করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হয় ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিলে। দুটি তফসিলের সম্পত্তি অবমুক্ত করতে লাখ লাখ মামলা হয় তখন। পরে সরকার ‘খ’ তফসিলের সম্পত্তি অবমুক্ত করে দেয়। জনসাধারণের দখলে থাকা এসব সম্পত্তি এমনিতেই ফিরিয়ে দেয়া হয়। এখন ‘ক’ তফসিলের সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে।

অর্পিত সম্পত্তির আরেক সমস্যা সেলামি হার নির্ধারণ
দীর্ঘদিন যাবত অর্পিত সম্পত্তির সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নামমাত্র দেয়া হলেও প্রায় ২৯ বছর পর অর্পিত সম্পত্তির সেলামির হার বাড়ানোর কাজে হাত দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, অর্পিত সম্পত্তি সংরক্ষণ, উন্নয়ন, সম্পত্তির ওপর চলমান মামলা-মোকাদ্দমা পরিচালনার ব্যয় মেটানো, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী, মাসিক বেতন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাড়তি ব্যয় মেটাতে এ উদ্যোগ নিচ্ছে মন্ত্রণালয়।

উপজেলা ও পৌর এলাকায় বর্তমান সেলামির ৫ গুণ, সিটি কর্পোরেশনভুক্ত (ঢাকার দুই সিটি ছাড়া) এলাকার ক্ষেত্রে ৬ গুণ এবং ঢাকার দুই সিটিতে ৭ গুণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে এই হার শুধু ‘ক’ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে বাড়বে।

দেশে সর্বমোট অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ৯ লাখ একর। এর মধ্যে ‘ক’ শ্রেণির ২ লাখ এবং ‘খ’ শ্রেণির ৭ লাখ একর। তবে ‘খ’ শ্রেণিতে সর্বাধিক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও এ শ্রেণিতে বাড়ানোও জরুরি বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

বিমল চন্দ্রের ছেলে শুকান্ত চন্দ্র আমার সংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছে। এ ক্ষেত্রে মামলাসংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী। তিনি বলেন, কখনো বাদি, কখনো সরকারপক্ষের আইনজীবী আবার কখনো বিচারক থাকেন না। সে কারণে মামলা শেষ হচ্ছে না।

তবে দ্রুত মামলা শেষ না হওয়ায় তারা আর্থিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত আমার সংবাদকে বলেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে যেসব মামলা বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন, তা নিষ্পত্তি হতে ৩০ বছর লাগবে। কারণ গত সাত বছরে মাত্র ১২ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হচ্ছে। আবার যারা মামলার মাধ্যমে সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার ডিক্রি বা রায় পেয়েছে, তাদেরও সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আমার সংবাদকে বলেন, অর্পিত সম্পত্তির মামলার জট এটা নতুন কিছু নয়। যদি এসব মামলার বিচারকাজ গতিশীল হয় তাহলে ভুক্তভোগীরা উপকৃত হবেন।

তিনি বলেন, ‘অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির মামলা নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে কি না, তা মনিটর করার কেউ নেই। যতদূর জানা গেছে, আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয় না।

অথচ সরকার দ্রুত অর্পিত সম্পত্তি মূল মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার জন্য এই আইন করেছিল। উচ্চ আদালতের নির্দেশও আছে, নির্ধারিত সময়ে মামলা শেষ করার।

কিন্তু ওই নির্দেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। এসব মামলায় আপিলেরও একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিলও করা হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ে জবাব না দেয়া বা আপিল না করার কারণে বিচারপ্রার্থীরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটা কাম্য নয়।’

হাইকোর্টের গত বছরের নির্দেশে বলা হয়েছে, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী করা আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রতি জেলায় বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে সরকার। সেই ট্রাইব্যুনালের অর্পিত সম্পত্তি আইনের অধীন করা আবেদন ছাড়া অন্য কোনো আবেদন নিষ্পত্তির এখতিয়ার থাকবে না।

এছাড়া যেসব জেলায় এ আইনের অধীন আবেদনের সংখ্যা অনেক বেশি, সেসব জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও ওইসব ট্রাইব্যুনালে অন্যান্য মামলার কার্যক্রমও চলে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, মামলার রায় বিচারপ্রার্থীর পক্ষে গেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার আপিল না করলে গেজেট প্রকাশ করে সম্পত্তি তাকে সরকারই বুঝিয়ে দেবে।

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তা না করে এক-দুই বছর পরও আপিল করা হয়। এটা বেআইনি বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

আমারসংবাদ/এসটিএমএ