Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

একজন অপ্রতিরোধ্য মহাপরিচালক

বেলাল হোসেন

আগস্ট ২২, ২০২০, ০৬:১২ পিএম


একজন অপ্রতিরোধ্য মহাপরিচালক

দেশে প্রাথমিক শিক্ষার মূল চ্যালেঞ্জটাই হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে সুন্দরভাবে সাজানো। ৬৫ হাজারের অধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় এক কোটি ৮৫ লাখ শিক্ষার্থী ছাড়াও কয়েক লাখ শিক্ষক নিয়ে বিশাল এ পরিবারকে সমন্বয় করে যাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন অপ্রতিরোধ্য মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ।

সার্বক্ষণিক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মনিটরিং ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে গোটা দেশে প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে ভয়াবহ করোনাভাইরাসের কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত বন্ধ।

এর মাঝেও প্রাথমিকের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের অনলাইনে লেসন পাঠ, জাতীয় সংসদ টিভির মাধ্যমে ‘ঘরে বসে শিখি’, বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ ছাড়াও স্থানীয়ভাবে কেবল টিভি ও মোবাইলের মাধ্যমে (ওয়ান টু ওয়ান) শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক করোনাকালীন সময়ে নিজেই অফিসে এসে সবার সঙ্গে বৈঠক করে এ নির্দেশনাগুলো দিয়ে গেছেন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুশিক্ষার্থীদের কথা মাথায় নিয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছেন অধিদপ্তরের এ বড়কর্তা।

এ কাজগুলো করতে গিয়ে মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ নিজেই চলতি মাসের প্রথম দিকে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হন। অসুস্থতার মাঝেও দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গেছেন সরকারের এ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের তছনছ করে দিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে একই অবস্থা।

তিনি বলেন, করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখার জন্য আমরা গত ৭ এপ্রিল থেকে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে ডিজিটাল ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা সারা দেশে একটা জরিপ করে দেখেছি ৬৬ শতাংশ ছেলেমেয়ে এই ডিজিটাল ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। আমরা টেলিভিশনের পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমেও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ শুরু করেছি যা পৃথিবীতে বিরল। তবে আফ্রিকার দু-একটা দেশে আছে।

এছাড়াও আমরা মোবাইলের মাধ্যমে ক্লাস লেসনের কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। আবার স্থানীয়ভাবে আমাদের শিক্ষকরা অনলাইনের মাধ্যমেও ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে সকল শিক্ষার্থীর মাঝে আমরা পড়াশোনার যে আগ্রহ এবং তাদের পড়াশোনার মাঝে রাখতে পারছি।

মহাপরিচালক আরও বলেন, আমরা একটা সফটওয়্যার তৈরি করেছি শিক্ষার্থীদের তথ্য সংরক্ষণে। ছেলেমেয়েরা যখন ক্লাসে অংশগ্রহণ করবে তখন অভিভাবকদের মোবাইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এন্ট্রি নিশ্চিত করা হবে। প্রতিটি ক্লাসের শেষে বিষয় কোড সেন্ড করতে হবে অভিভাবকদের। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে জানা যাবে কতজন শিক্ষার্থী বেতারের ক্লাসে অংশ নিয়েছে।

এছাড়াও আমরা শিক্ষকদের অনলাইনে ট্রেনিংয়ের বিষয় উদ্বোধন করেছি। এখন সাবজেক্টবেজ ট্রেনিংগুলো অনলাইনে দেয়া শুরু হয়েছে বলে জানান মো. ফসিউল্লাহ।

তিনি বলেন, পিটিআইতে যেসব শিক্ষক আছেন তাদের অনলাইনে ট্রেনিং ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এছাড়াও নতুন যে ১৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের অনলাইনে ট্রেনিং শুরু হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

মহাপরিচালক বলেন, আমাদের শিক্ষার পদ্ধতিটা হচ্ছে ফেস টু ফেস। করোনা মহামারির কথা উল্লেখ করে  মো. ফসিউল্লাহ বলেন, অনলাইন, টেলিভিশন ও বেতারের মাধমে ক্লাস নিয়ে হয়তো শতভাগ শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে অন্তত শিক্ষার্থীদের একটু ব্যস্ত রাখতে তো পারছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে স্কুল খুললে কি করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা নিয়ে আমরা প্ল্যান করছি।

স্কুল খোলার পর কতদিন পাবো, এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে কীভাবে তুলবো। সমাপনী পরীক্ষাটা হবে কি না, যদি হয় তা কীভাবে হবে এগুলো নিয়ে আমাদের ছোট ছোট প্ল্যান আছে।

এর মধ্যে দুমাস আবার তিন মাসেরও প্ল্যান করা হয়েছে। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আমরা সবাইকে বিষয়গুলো জানিয়ে দেবো বলে জানান মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ।

করোনাকালীন সময়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেশকিছু কার্যক্রমের বিষয়ে তথ্য চেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক তথ্য বিভাগীয় উপ-পরিচালককে পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়।

এছাড়া ভার্চুয়াল মিটিং কতটি করা হয়েছে এবং শিক্ষকরা স্ব-প্রণোদিতভাবে কতটি পরিবারকে সহায়তা করেছেন তাও জানতে চাওয়া হয়েছে নির্দেশনায়। প্রাথমিক অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষার্থীরা বাসায় কী করছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না, লেখাপড়া কতটা করছে, সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাসগুলো ভালো করে দেখছে কি না, মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থীরা কতটা সহায়তা পাচ্ছে তা জানতে টেলিফোন আলাপের উদ্যোগ নেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

শিক্ষার বিষয়ে আলোচনাসহ স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়েও মোবাইল ফোনে আলাপ-আলোচনা করবেন শিক্ষকরা। এতে শেখানোর বিষয় ছাড়াও নতুন করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের নতুন সেতুবন্ধ তৈরি করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন ৭০০ জন আক্রান্ত হন করোনায়। এদের মধ্যে ৯০ জন কর্মকর্তা, ৪৮ জন কর্মচারী, ৫৩৯ জন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছে ২৩ জন। শিক্ষকসহ মারা গেছেন ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এদের মধ্যে দুইজন কর্মকর্তা, একজন কর্মচারী ও ১৭ জন শিক্ষক। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রাথমিক শিক্ষক-কর্মচারী ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২৪টি নির্দেশনা জারি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নির্দেশনা জারি করে। এ অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এর আওতাধীন সব দপ্তর/সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়।

২৪ নির্দেশনা
১) প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন ও অফিসে সার্বক্ষণিক মাস্ক ব্যবহার করুন। ২) শারীরিক তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করুন। ৩) নিজের মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলুন। ৪) জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে অফিসের দরজা, আলমারির হাতল, লক, হ্যান্ডেল, চেয়ার, টেবিল, বৈদ্যুতিক সুইচ ইত্যাদি পরিষ্কার রাখুন। ৫) বাইরে থেকে সরবরাহ করা প্যাকেটের নাস্তা/খাবার যতদূর সম্ভব পরিহার করুন। ৬) নিজের ব্যবহার করা জিনিসপত্র (বেল্ট, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি) নিজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। ৭) অফিসে কাজ করার সময় ন্যূনতম ৩ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। ৮) নির্দিষ্ট সময় পর পর সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাত পরিষ্কার রাখুন। ৯) দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনে সহকর্মীদের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। ১০) নিজ নিজ কক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং সংশ্লিষ্ট ভবনে নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন। ১১) একান্ত প্রয়োজন না হলে অন্যের রুমে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ১২) কোনো রুমেই একসঙ্গে চারজনের বেশি প্রবেশ বা অবস্থান করা থেকে বিরত থাকুন। ১৩) দর্শনার্থী সীমিত করুন এবং তাদের সঙ্গে সাক্ষাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখুন। ১৪) কেউ খাবার বা নামাজরত থাকলে ওই কক্ষে প্রবেশ থেকে বিরত থাকুন। ১৫) যতদূর সম্ভব লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। একান্ত প্রয়োজনে একসঙ্গে অনধিক চারজন লিফট ব্যবহার করুন। ১৬) লিফটে মুখোমুখি দাঁড়াবেন না, দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। ১৭) লিফটের বাটনে চাপ দেয়ার সময় খুব ভালো হয়, যদি অ্যালকোহল প্যাড বা টিস্যু ব্যবহার করুন। সেগুলো হাতের কাছে না থাকলে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে অথবা কনুই দিয়ে বাটনে চাপ দিন। ১৮) লিফট থেকে নেমে হাত পরিষ্কার করে নিন। ব্যবহূত অ্যালকোহল প্যাড বা টিস্যু নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন। ১৯) লিফটের ভেতর যতটা সম্ভব হাঁচি-কাশি দেয়া থেকে বিরত থাকুন। একান্ত প্রয়োজন হলে রুমাল বা টিস্যুতে মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দিন। ব্যবহার করা রুমালটি জীবাণুমুক্ত করে ধুয়ে ফেলুন এবং ব্যবহূত টিস্যুটি ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলুন। ২০) ই-নথি ব্যবহার করুন। ২১) হার্ড ফাইল স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ফাইল বহনকারী নির্ধারিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। ২২) হার্ড ফাইল/কাগজপত্রাদি স্পর্শ করার পর হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। ২৩) করেনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের এবং বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ বাসায় ও অফিসে প্রতিপালন করুন। ২৪) স্বাস্থ্যবিধি নিজে মেনে চলুন এবং অন্যকে মেনে চলতে উৎসাহিত করুন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার।

আমারসংবাদ/এসটি