Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

গতি নেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের!

শরিফ রুবেল

আগস্ট ২৪, ২০২০, ০৬:০৩ পিএম


গতি নেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের!

আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরনো হাইকোর্ট ভবনে যাত্রা শুরু করে। একাত্তরে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধের বিচারে গঠন করা হয় এই ট্রাইব্যুনাল।

শুরুতে  ট্রাইব্যুনালটি দ্রুত বিচারকাজ পরিচালনা করলেও বর্তমানে গতি হারিয়েছে। সময়ের সাথে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না নিষ্পত্তির হার। বিচারকাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে। কমানো হয়েছে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাও।

ফলে একটিমাত্র ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধীদের বিচারে সৃষ্টি হয়েছে মামলাজট। মূলত শীর্ষ ছয় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ও সাজা কার্যকরের পর ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে গতি কমে এসেছে। আলোচিত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি সম্পন্ন হওয়ার পরই মূলত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে পরবর্তী বিচারকাজ।

সেইসাথে সাক্ষী হাজির ও তদন্তের সময় ক্ষেপণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিচারকাজ। আবার প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবের মামলার তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করাও সম্ভব হচ্ছে না। গত সাড়ে সাত মাসে একসময়ের আলোচিত এই ট্রাইব্যুনালে হয়নি কোনো বিচারের রায়।

সর্বশেষ গত বছর ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর টিপু সুলতান (ওরফে টিপু রাজাকার) মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন বিচারপতি মো. শাহীনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এবং গত বছর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাতটি মামলার রায় দেয়া হয়েছিল।

চলতি বছরের অর্ধেক সময় পার হলেও রায় হয়নি কোনো মামলার। এখনো আপিল বিভাগে অন্তত ৩০টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। দীর্ঘসময় আটকে আছে ৬৯০টি অভিযোগের তদন্তকাজ। বিভিন্ন সময়ে আসা এসব অভিযোগের তদন্ত কবে শুরু হবে, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান চললেও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য-প্রমাণের অপ্রতুলতা, লোকবলের স্বল্পতা এসব নানা কারণে অভিযোগগুলোর তদন্ত কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটা কারণ হয়তো হতে পারে যে, আলোচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়ে গেছে, অনেকের দণ্ডও কার্যকর হয়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। কিন্তু সরকারের ঘোষণা ছিলো, দেশে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী থাকা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কাজ চলবে।

তারা বলেন, মামলার যে ধীরগতি তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর এখন মাত্র একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। দুটি ট্রাইব্যুনাল করা হলেও একটি ট্রাইব্যুনাল এখন আর নেই। সে জন্য মামলা বিচারে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ট্রাইব্যুনালের একাধিক প্রসিকিউটর জানান, পূর্ণাঙ্গভাবে বিচারকাজ দ্রুত শুরুর সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩৬টি মামলার মধ্যে ২০টিরও বেশি মামলা চার্জ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায় রয়েছে। করোনাজনিত পরিস্থিতিতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত কাজও ধীরগতিতে চলছে। তাই কাজ শুরু করতে এখনো দেরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও প্রসিকিউশন সংস্থার তথ্যমতে, ১০ বছরে ৪১ মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনালে ৯৬ যুদ্ধাপরাধীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ (ফাঁসি) হয়েছে ৭০ জনের। আমৃত্যু সাজা হয়েছে ২৫ জনের এবং ২০ বছর সাজা হয়েছে একজনের। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৬টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলায় মোট আসামি ২৩৬ জন। ২১টি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।

 একটি মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ। তিনটি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি মামলা অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতে মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তির পর সাজা কার্যকর হয়েছে ছয় যুদ্ধাপরাধীর।

অন্যদিকে, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে আরও ২৯টি আপিল। ৭৭টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৬১ জন আর পলাতক রয়েছে ১৪৪ জন। বর্তমানে জামিনে আছে চারজন। গত ১০ বছরে মারা গেছে ১৯ আসামি।

আপিলে বিচারের অপেক্ষায় যারা : ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়ে বর্তমানে আপিলে বিচারের অপেক্ষায় আছে ৩০ জন। তারা হলেন— জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম (এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে), জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সার, মোবারক হোসেন (আ.লীগের বহিষ্কৃত নেতা), অব্দুল জব্বার, মাহিদুর রহমান, সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, খান মো. আকরাম হোসেন, ফোরকান মল্লিক, ওবায়দুল হক (তাহের), আতাউর রহমান ননী, মজিবুর রহমান (আঙ্গুর মিয়া), মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া, সামসুদ্দিন আহম্মেদ, শামসুল হক, এস এম ইউসুফ আলী, মো. সাখাওয়াত হোসেন, বিল্লাল হোসেন, মো. মোসলেম প্রধান, মো. আব্দুল লতিফ, ইউনুছ আহমেদ, আমীর আহম্মেদ ওরফে আমীর আলী, মো. জয়নুল আবীেদন, মো. আব্দুল কুদ্দুস, হামিদুর রহমান আজাদ, এ গনি ওরফে এ গনি হাওলাদার, মো. রিয়াজ উদ্দিন ফকির, মো. আকমল আলী তালুকদার, মো. ইসহাক সিকদার, মো. আব্দুল কুদ্দুস ও মো. মাহবুবুর রহমান। এর মধ্যে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিলটি গত ৩১ অক্টোবর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। এখন রিভিউয়ের পর্যায়ে রয়েছে।

অন্যদিকে তদন্ত সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, তদন্তাধীন আছে ২৮টি মামলা। যার আসামি সংখ্যা ৪০ জন। তদন্ত সংস্থার কাছে অভিযোগ জমা রয়েছে ৬৯০টি।

কেন আলোচনায় নেই ট্রাইব্যুনাল? : শুরুর কয়েক বছর ট্রাইব্যুনাল যেভাবে আলোচিত ছিলো, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো, সেই আলোচনা আর আগ্রহ এখন ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নেই। সাধারণ মানুষও এখন আর আগের মতো রায়ের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে না। এখন রায় হলে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বহীনভাবে খবর পরিবেশন করে।

যেভাবে কাজ করে ট্রাইব্যুনাল : টাইব্যুনালের দুটি অংশ— তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশন। তদন্ত সংস্থা কোনো মামলার তদন্ত পুরো শেষ করে প্রসিকিউশনকে দিলে প্রসিকিউশন মামলা করে ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনাল মামলার বিচারকাজ শেষ করে রায় ঘোষণা করে। তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা যায়।

ফলে রায় কার্যকর হয় আপিল বিভাগের রায়ের পরই। আপিল বিভাগের রায়ের পরও রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার আইনি সুযোগ আছে।

ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর (প্রশাসন) জেয়াদ আল মালুম বলেন, করোনা ভাইরাস না থাকলে গত তিন মাসে অনেক মামলাই নিষ্পত্তির পর্যায়ে চলে যেত। এখন আগামীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সে সম্ভাবনা নেই। মামলার বিচার কার্যক্রম আপাতত মূলতবি রয়েছে।

তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অসুস্থ, বয়স্করা কর্মস্থলে যাবেন না। আমরা যারা ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত রয়েছি তাদের প্রায় সবার বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। এ মুহূর্তে আমাদের ঝুঁকি নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আসামি হাজির করাও সম্ভব নয়। আমরা প্রসিকিউটররা পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি।

এদিকে তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, গত ১০ বছরে আসা অভিযোগ ও মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭৭টি অভিযোগের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৪১টির রায় হয়েছে। এখন ৬৬২টি অভিযোগ তদন্ত শুরুর অপেক্ষায়। এমনিতেই তদন্ত সংস্থায় লোকবলের স্বল্পতা, ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজে ধীরগতির কারণে অভিযোগের তদন্তে এক ধরনের স্থবিরতা ছিলো। এখন করোনা পরিস্থিতিতে তা আরও পিছিয়েছে।

তদন্তের এই ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, এখন ৬৬২টি অভিযোগ তদন্ত শুরুর অপেক্ষায়। এমনিতেই তদন্ত সংস্থায় জনবলের অভাব রয়েছে। তার ওপর করোনা পরিস্থিতি ও একজন সদস্য না থাকায় ট্রাইব্যুনালে।

তিনি বলেন, লোকবলের অভাবের কারণে মামলার তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সংস্থায় ২৩ জন তদন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এদের মধ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তা ১৭ জন। রুটিন মাফিক কাজ চলছে। তাই তদন্ত কাজেও স্থবিরতা এসেছে।

তিনি বলেন, আগে প্রতি মাসে একটি দুটি প্রতিবেদন দেয়া হতো। এখন তদন্ত কর্মকর্তারা কোথাও যেতে পারছেন না। তাই নতুন কোনো তদন্ত শুরু করাও যাচ্ছে না। শুধু সাক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।

আমারসংবাদ/এসটিএম