Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

গলা কাটছেন ঢাকার ব্যবসায়ীরা

জাহাঙ্গীর আলম

অক্টোবর ২০, ২০২০, ০৬:০৬ পিএম


গলা কাটছেন ঢাকার ব্যবসায়ীরা

বগুড়ার শাহজাহানপুর টিএমএস কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু কেনা হয় ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি।  ১৫ টন আলু বহনে সব মিলে ট্রাক ভাড়া ১৯ হাজার টাকা। আড়তদারি প্রতি কেজিতে ৬০ পয়সা।

সেই আলু রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আড়তে বিক্রি করা হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা কেজি। শুধু বগুড়া নয়, সমগ্র উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে মুন্সীগঞ্জের আলুও ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি কিনে ঢাকাতে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।

গতকাল মুন্সীগঞ্জের পলাশ এভাবেই আলু বেচাকেনার চিত্র তুলে ধরেন। কৃষিমার্কেটসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে এই দামে বিক্রি হচ্ছে বলে নিউ শাহআলম বাণিজ্যালয়ের শাহ আলম জানান। কিন্তু খুচরা বাজারে সেই আলু ৫০ টাকার নিচে বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা স্টক করে রাখছেন আলু। সিন্ডিকেট করে গলা কাটছেন ভোক্তাদের।

প্রায় এক মাস আগে হঠাৎ আলুর দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেলে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৩ টাকা, পাইকারি ২৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারপরও ঢাকাতে আলু ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না।

সমালোচনার জবাবে সোমবার বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, দেশে প্রয়োজনীয় আলু মজুদ রয়েছে। আলু সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই। টিসিবি ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে প্রতি কেজি আলু ২৫ টাকা বিক্রি করবে। তারপরও ব্যবসায়ীরা ৫০ থেকে ৬০ টাকার নিচে বিক্রি করছেন না আলু।

ভোক্তা অধিদপ্তর জরিমানা করলেও আলু ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযানে গেলে কোনো কোনো বাজারে আলু বিক্রি বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। গোয়েন্দা নজরদারি না বাড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
 
সরকারের উদ্যোগ আমলে নিচ্ছেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা : চলতি মাসের শুরুতে হঠাৎ করে রাজধানীতে আলু দাম দ্বিগুণ— ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে হইচই পড়লে  গত ৭ অক্টোবর কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ২৩ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ২৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

একই সাথে ভোক্তা, আড়ত ও কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে আলুর সর্বোচ্চ দাম কার্যকর করতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি পাঠানো হয়। তারপরও আলু ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। ব্যবসায়ীরা ৫০ থেকে ৬০ টাকার নিচে বিক্রি করছেন না আলু। পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে মাসের ব্যবধানে আলুর দাম দ্বিগুণ বেড়ে খুচরা বাজারে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ভোক্তাদের স্বার্থে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারপরও আলু ব্যবসায়ীরা দাম কমাচ্ছেন না ভোক্তা পর্যায়ে।

বাধ্য হয়ে সোমবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে বাজারে আলু বিক্রি নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে। দেশে প্রচুর আলু আবাদ হয়েছে। প্রয়োজনীয় আলু মজুদ রয়েছে।

আলু সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো অবস্থাতেই অধিক লাভ করার সুযোগ দেয়া হবে না। ক্রেতাদের সাশ্রয়ী মূল্যে আলু সরবরাহের উদ্দেশ্যে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) আলু বিক্রি শুরু করবে। ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে প্রতি কেজি আলু ২৫ টাকা বিক্রি করবে টিসিবি।

কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন, আলুর পাইকারি বিক্রেতা, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তারপরও গতকাল রাজধানীর কৃষিমার্কেটসহ বিভিন্ন বাজারে কোনো ক্রমেই ৫০ টাকার নিচে কেজি আলু বিক্রি করছেন না।  

একদিন পর আবারো হিমাগার মালিক, কৃষক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে আলুর নতুন দাম নির্ধারণ করেছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ। তাতে আগেরে চেয়ে কেজিতে পাঁচ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

নতুন এ দর অনুযায়ী, হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম কেজিপ্রতি ২৭ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা। ঘোষণার পর থেকে আলুর নতুন এ দর কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।

সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজি হলেও লাভ হবে : কিন্তু বাস্তবে এই দাম কার্যকর করা আদৌ সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কারণ কোল্ড স্টোরেজে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজির আলু রাজধানীতে ৫০ টাকার নিচে বিক্রি করছেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা কম দামে কিনে স্টোর করে রেখে দিচ্ছেন। কেউ বা বেশি দামে বিক্রি করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় আগেও দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু মানছেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট করে তারা বেশি দামে বিক্রি করছেন আলু।

গলা কাটছেন ভোক্তাদের বলে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সহকারী পরিচালক মো. মজিবুর রহমান অভিযোগ করে জানান। তার এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় ২৮ বছরের অভিজ্ঞ পাইকারি আলু ব্যবসায়ী পলাশের কাছে।

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, এবারে উত্তরবঙ্গে অনেক আলু হয়েছে। সরকারও তা বলছে। কিন্তু বন্যায় সবজির ক্ষতি এবং করোনায় আলু সাহায্য দেয়ার চাহিদা বেশি। আবার রপ্তানি করা হচ্ছে আলু। তাই কোল্ড স্টোরেজে যারা আলু রেখেছেন তারা অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার বেশি দামে বিক্রি করছেন। ৪০ টাকা কেজি বিক্রি করলেও অনেক লাভ থাকে।

কিন্তু রাজধানীতে যেভাবে বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে তা খুবই দুঃখজনক। এত বেশি হতে পারে না। অনেকেই পেঁয়াজের মতো স্টোরে রেখে দিচ্ছেন আরো বেশি দামের আশায়। সরকার অভিযান বাড়ালে ভয়ে তারা গুদামজাত করতে পারবে না। তাহলে দামও বাড়বে না।

সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যবসায়ায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি এবং রংপুরের মোস্তফা কোল্ড স্টোরেজসহ সাতটি কোল্ড স্টোরেজের মালিক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আমার সংবাদকে বলেন, ‘গতকালের কৃষিমন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া ৩৫ টাকা কেজি দাম কার্যকর হতে পারে। ভোক্তারা কম দামে পেতে পারেন আলু।’

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত আলু উৎপাদন হয়েছে। যারা আগে আলু কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন এ দামে বিক্রি করলেও তাদের প্রতি বস্তায় ৪০০ টাকা লাভ থাকবে। কিন্তু যারা বেশি দামে স্লিপ কিনেছেন তাদের ব্যাপার ভিন্ন।

কোল্ড স্টোরেজের ৩২ টাকার আলু আড়তে ৩৬ টাকা বিক্রি হলেও ভোক্তাদের ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা ১০ টাকা লাভ করছেন। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীরাও বিভিন্নভাবে জড়িত থাকতে পারে। আড়তে লেবার, চাঁদাবাজির ভাগসহ খুচরা পর্যায়ে তা সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজি হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। শুধু ভোক্তা অধিদপ্তর দিয়ে বাজার অভিযানে অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক করা যাবে না। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। তা কাজে লাগাতে হবে।

সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। দেখতে হবে কারা বেশি লাভ করছে, বাজার অস্থির করছে। তা শনাক্ত করে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে আলুর বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে এই অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।  

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এবার আলুর উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে মোট কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা ৪০৭টি। বর্তমানে চালু আছে ৩৯৩টি। এসব হিমাগারে এবার ৪৫ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করে।

এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ আলু বাজারজাত হয়েছে। তার মধ্যে ১০ লাখ টন বীজ আলু। বাকি আলু এখনো হিমাগারগুলোতে রয়ে গেছে। তারপরও কমছে না আলুর দাম। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তা অতিরিক্ত।

এ বছর আলুর উৎপাদন ১০ লাখ টন কম হয়েছে। তারপরও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ কোল্ড  স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোস্তাক হোসেন।

আমারসংবাদ/এসটিএম