Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

কূলকিনারা হয়নি হাসনাত করিম রহস্যের

আব্দুল লতিফ রানা॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ২, ২০১৭, ০৭:৩৪ এএম


কূলকিনারা হয়নি হাসনাত করিম রহস্যের

গুলশানের হত্যাজঙ্গ ও জঙ্গিদের সঙ্গে রহস্যজনক চলাফেরা, পাশের বাড়ির ছাদ থেকে ধারণ করা ভিডিও, গ্রেপ্তার ও রিমান্ডসহ হাসনাত করিমের রহস্যের কুলকিনারা এখনও হয়নি।

জঙ্গিদের জিম্মিদশায় তাদের সঙ্গে হাসনাত করিম বারবার কথা বলেছেন। হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন এবং ‘সেনাবাহিনীর অপারেশন থান্ডার বোল্ড’ অভিযানের আগেই সকাল বেলায় তারা পরিবারসহ জিম্মিদশা থেকে ম্ক্তু হন। আলোচিত এই মুখটি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন শিক্ষকও ছিলেন বলে জানা গেছে। আর নিহত জঙ্গিদের মধ্যেও একজন ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও ছিল। হাসনাত করিম তার মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সেই রাতে খাবার খেতে স্বপরিবারে হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন বলে উদ্ধার হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের পর বলেছিলেন তিনি। জিম্মি অবস্থায় তার সঙ্গে স্ত্রী শারমিনা করিম, তার দুই সন্তান শেফা করিম ও রায়হান করিমও ছিলেন। জঙ্গিদের হত্যাজঙ্গের পর সেখানে অন্যান্য জিম্মিদের মতো তারাও স্বপরিবারে জিম্মি ছিলেন। পরেরদিন তারা মুক্ত হওয়ার পর তাদেরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ করে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আর তখনই পাশের বাড়ির ছাদ থেকে এক বিদেশি ব্যক্তির ভিডিও ফুটেজ এক জঙ্গির সঙ্গে হাসনাত করিমের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর হাসনাত করিমকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। পরে প্রথমে তাকে আটক করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এসময় জঙ্গিদের সঙ্গে হাসনাতের কোন প্রকার সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা নিয়ে গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করে।

একপর্যায়ে হাসনাত করিমকে দীর্ঘ সময় ধরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসির) ইউনিটের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট তাকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে প্রথমে ৮ দিনের রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর গত বছর ১৩ আগস্ট হালি আর্টিজানে জঙ্গিহামলার মামলায় হাসনাত করিমকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি এখনও জেলহাজতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এখনও হাসনাত করিমের বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। মামলার তদন্তকাজও এখনও চলছে। তদন্ত শেষ হলে তার বিষয়ে পরিষ্কার হবে বলে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন।

সিটিটিসির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন সাবেক শিক্ষক জিম্মি অবস্থা থেকে পরিবারসহ ছাড়া পাওয়ার পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সেই রাতের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের জন্মদিন ছিল ১ জুলাই। রোজার কারণে আমার স্ত্রী বাসায় অতিথিদের দাওয়াত দিতে চাননি। তাই রেস্তোরাঁয় জন্মদিন উদযাপন করতে যাই। এজন্য হলি আর্টিজান বেছে নেওয়া হয়। আর রেস্টুরেন্টটি বাসার কাছেই ছিল এবং সেখানকার খাবারের মানও খুবই ভালো ছিল। ঘটনার দিন সাড়ে ৮টার পর বাসা থেকে বের হয়ে রেস্তোরাঁয় পৌঁছানোর আমাদের খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। আর তারা যখন আমাদের খাবারের মেন্যু দেখাচ্ছিল, তখনই হামলাকারীরা সেখানে প্রবেশ করে। তখন আনুমানিক সময় রাত ৮টা ৪৫ মিনিট।

হাসনাত করিম গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো বলেছিলেন, প্রথমে আমি আমার পেছনের টেবিলে কিছু শব্দ শুনতে পাই। কী হচ্ছিল তা নিশ্চিত ছিলাম না, তাই পেছনে ফিরে তাকাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছু ব্যক্তি অস্ত্র হাতে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করছিল। এসময় তারা কিছু মানুষকে গুলি করে আর ধারালো অস্ত্র দিয়েও আঘাত করে। হামলাকারীদের একজন আমাদের টেবিলে এসে থামে এবং বলে তারা আমাদের কিছু করবে না কিন্তু আমাদের দূরের টেবিলে গিয়ে বসা উচিত। আমাদের টেবিলে ছিলাম আমি, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে এবং আমার মেয়ে।’

তাদের কথা মত আমি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দূরের একটি টেবিলে গিয়ে বসি। কিছু সময়ের মধ্যেই তারা অনেক মানুষ হত্যা করে। এরপর তারা আরও কিছু মানুষকে আমাদের টেবিলে নিয়ে আসে। এর মধ্যে ছিল তাহমিদ হাসিব খান, ফাইরুজ মালিহা এবং তাহানা। এরপর আরেক ভদ্রলোকও আমাদের টেবিলে আসে। তিনি এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলে। আর জানতে চায়, আমরা মুসলিম কি না, আমরা নামাজ পড়ি কি না, ভোট দেই কি না ইত্যাদি। আমি তাকে বললাম যে আমি নামাজ পড়ি আর ভোট দেই না। এসময় সে সুরা আল ফাতিহা তিলাওয়াত করতেও বলে, আমি তা করি। সে সুরার অর্থও আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু আমি তা ঠিকভাবে বলতে পারিনি। ওই সময় তারা আর বেশি কিছু করেনি বিধায় আমি স্বস্তি বোধ করছিলাম। এসময় জঙ্গি হামলা ও জিম্মি অবস্থার সংবাদ মিডিয়ার কল্যাণে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। হলি আর্টিজানের ভেতরে থাকা জিম্মিদের স্বজনরা তাদের ফোন করছিলেন। আর ফোন বাজছিল নিহতদেরও ফোনেও। হাসনাতসহ অন্য জিম্মিদের হত্যা করা হবে না বলা হলেও ওই পরিস্থিতিতে কোনও কিছুতেই তাদের আশ্বস্ত হওয়ার উপায় ছিল না।

একপর্যায়ে জঙ্গিরা মেয়েদেরকে এক পাশে আর পুরুষদের অপর দিকে বসায়। ছেলেদের দিকে প্রতিবার একেকজন টয়লেটে যাওয়ার পর আমাদের তিনজনের অবস্থান পাল্টাচ্ছিল। এসময় জঙ্গিরা টেক্সটিংয়ের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ফোন ব্যবহার করে যোগাযোগ করছিল। এক হামলাকারী আরেকজনকে নির্দেশনা দিলো যে ওপর থেকে কনফার্ম করার হুকুম এসেছে। তারা কনফার্ম করতে চেয়েছিল যে সবাই আসলে মারা গেছে কিনা। এসময় তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মৃত ব্যক্তিদের আঘাত করতে লাগল। আবার কেউ কেউ তখনও জীবিত ছিল আর আমরা তাদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম যখন ধারালো ছুরি দিয়ে তাদের বারবার আঘাত করা হচ্ছিল।

হাসনাত করিম আরো জানিয়েছে, শিশির নামে এক কুককে দিয়ে জঙ্গিরা কিছু খাবার রান্না করিয়েছিল। রোজা রাখার জন্য জিম্মিদের সেহরি খেতে দেয়। অস্ত্রের মুখে ভয়ে কেউ কেউ একটু-আধটু খেয়েছেন। তখন একজন জঙ্গি ইসলামিক স্টেটের কর্মকা-ের পক্ষে কথা বলে। এসময় তার কাছ থেকে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সটি নিয়ে নেয়। রাত সোয়া ৩টার দিকে তারা তাদেরকে উঠে বসতে বললো। সেহরি দিতে চেয়েছিল। আর রোজা রাখা উচিত বলে তাদেরকে জানানো হয়। তখন কিছু খাওয়ার পর পুনরায় টেবিলে মাথা নিচু করে থাকতে বলা হয়। তিনি বলেছেন, ভোর সাড়ে ৪টার দিকে টয়লেটের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় একজন হামলাকারী তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আমার সঙ্গে বৈধ কোনও পরিচয়পত্র আছে কিনা? আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখতে চায় কিনা? সে বলল কোনও আইডি হলেই হবে। এরপর তাকে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখালাম। সে বললো সেটা রেখে দেবে। কাজেই আমি টয়লেট সেরে টেবিলে ফেরত গেলাম। তার কাছেও বন্দুক ছিল।
এক পর্যায়ে তারা প্রচারকের অডিও রেকর্ডিং বাজায়। এতে ইসলামিক স্টেটের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং তাদের বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যার মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। তারা বলছিল যে, সিআইএ মুসলিম দেশগুলোতে অনধিকার চর্চা করছে এবং ক্ষমতায় বসাচ্ছে মধ্যপন্থী (মডারেট) সরকারকে। পক্ষান্তরে তারা সব মুসলিম দেশগুলোয় ইসলামিক ব্যবস্থা চায়। এর মধ্যে তাদের একজন তার কাছে জানতে চায়, ওই রাতের বিশেষত্ব কী ছিল। যদিও আমার মতে ওই রাত শব-ই-কদর ছিল না, আমার মনে হয়েছিল সে চায় আমি বলি এটা শব-ই-কদরের রাত ছিল। আর তাই আমি বললাম, এটা শব-ই-কদর। আমার কপাল ভালো, সে মেনে নিল। এরপর সে জিজ্ঞাসা করলো ওই বিশেষ রাতে ভালো কর্মের জন্য কী বিশেষ পুরস্কার পাওয়া যায়? আমি বললাম সাধারণ রাতের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
একপর্যায়ে তারা তাকে মেরে ফেলবে কিনা জানতে চায়। এরপর সে বলল লেকের সাইডে হেঁটে যেতে এবং সে লেকের দিকে হাত নাড়লো যেন সেখানে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল। সে বলল, এক পাশে মানুষজন অপেক্ষা করছে আর অন্যদিকে পুলিশ অপেক্ষা করছে স্নাইপার নিয়ে। সে আমাকেও হাত নাড়তে বললো কিন্তু এর কোনও অর্থ বুঝলাম না। এরপর সে আমাদের সামনের দিকে লেকভিউ ক্লিনিকের মুখোমুখি নিয়ে গেল। সে ক্লিনিকের পাশের ভবনের দিকে নির্দেশ করে বললো ওই ভবনের ছাদে পুলিশ সদস্যরা আছে। কী করবো বা বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে করছিলাম তার উচিত আমাদের যেতে দেওয়া।

জঙ্গি রোহান জিজ্ঞাস করলো কিভাবে এই সংকট শেষ হওয়া উচিত। এসময় আমাদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলাম। পরে আমি তাকে বলেছিলাম অন্তত নারী আর শিশুদের ছেড়ে দিতে কিন্তু সে সম্মত হলো বলে মনে হলো না। ছাদ থেকে তাকে ও তাহমিদকে ফের ভেতরে পাঠানোর পর একপর্যায়ে একটি মুহূর্ত আসে যখন সব জিম্মি সদস্যদের ছেড়ে দেয় জঙ্গিরা। সবার মোবাইল ফোন ফেরত দেয়। হাসনাতকে বলে গেট খুলে দিতে। এরপর সবাইকে হলি আর্টিজান বেকারি থেকে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়।

এরপর বাইরে গিয়ে ছোট দরজার তালা খুলে দেন তিনি। জঙ্গি রোহান তাদের সবাইকে দাঁড়াতে বলল। সবার আগে হাসনাত করিম তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে বের হন। পেছনে তার স্ত্রী ও ছেলে ছিল। এরপর এনএসইউর দুই মেয়ে তারপর তাহমিদ ও সাত প্রকাশ। বাইরের দিকে হেঁটে রেস্তোরাঁ থেকে বের হন। এরপর পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে উদ্ধার করে।