Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ছোট নেতার বড় ছবি পোস্টার ব্যানারে

নূরে আলম জীবন॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ৩, ২০১৭, ০৫:৫৪ এএম


ছোট নেতার বড় ছবি পোস্টার ব্যানারে

আত্মপ্রকাশে দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে পবিত্র ঈদে ‘শুভেচ্ছার নামে’ নিজেদের ছবি ব্যবহার করে ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ঢাকা শহর ছেয়ে ফেলেছেন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ব্যানার ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির সাথে অন্য কারো ছবি ব্যবহার না করার নির্দেশনা দেয়া হলেও অনেকে পোস্টারে শুধু নিজেদের ছবি, আবার কেউ কেউ নেতাদের সঙ্গে নিজের ছবি ব্যবহার করে ঈদে নিজ নিজ এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

দলীয় নেতাকর্মীরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এ ধরনের প্রচারেই শুধু ব্যস্ত নন, পোস্টারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ছবির থেকেও নিজের ছবি বড় করে এক প্রকার দুঃসাহস প্রদর্শন করছেন। তারা দলীয় অফিসের আশপাশে নিজেদের এ ধরনের প্রচারণা বেশি চালিয়েছেন। যারা এ প্রচারণায় নিষেধ করেছেন তাদেরই দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে পার্টি অফিসের কাছে এমন প্রচারণা চালিয়ে। গুলিস্তান পার্টি অফিসে ঢোকার পথেই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে দেয়াল। বিভিন্ন সড়কের মাঝে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানো হয়েছে ফেস্টুন। নেতাকর্মীদের এ আত্মপ্রচারের পোস্টারেই সৌন্দর্যহানি ঘটছে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের আশপাশও। বেশি দৃষ্টিকটূ লাগছে পোস্টার ও ব্যানারে নেতাদের ছবি ছোট করে নিজের ছবি বড় করার দৃশ্য।

সবুজবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান শাহরিয়ার এমনই একজন আওয়ামী লীগকর্মী। তিনি নেতাদের ছবি ছোট করেছেন এবং নিজের ছবি তুলনামূলক বড় দিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা প্রচারণা চালিয়েছেন। যেখানে দলের সর্বোচ্চ নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। দলের শীর্ষনেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ছবি ব্যবহারের নির্দেশনা না মেনে আত্মপ্রচারণায় ব্যস্ত সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ব্যানার-পোস্টার ও লিফলেটে এখনও আত্মপ্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ ও দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলোকে ঘিরে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাদের আত্মপ্রচারণা।

এ প্রচারণা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কখনও কখনও স্বাধীনতার স্থপতি, দলের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকেও ছাড়িয়ে যায়। সর্বশেষ ২৬ জুন সোমবার পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে নেতাকর্মীদের আত্মপ্রচারণা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ও শেখ হাসিনার ছবি একেবারেই ছোট আর ওয়ার্ড, থানা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবি বড় করে ব্যানার-পোস্টার ও লিফলেটে এসেছে। ঢাকার এমপিদের ছবিও এসবকিছুতে বড় করে এসেছে। অথচ দলীয় নেতাকর্মীদের আত্মপ্রচারণা ঠেকাতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছবি ব্যবহারের ওপর একটি নির্দেশনা জারি করেন। গত ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পোস্টার-ব্যানার, বিলবোর্ড ও লিফলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ছাড়া কারও ছবি ব্যবহার করা যাবে না। তবে দল থেকে এমন নির্দেশনা দেয়ার পরও কার্যত নেতাকর্মীদের আত্মপ্রচারণা ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।

সরজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ি, শ্যামপুর, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, মৌচাক, মগবাজর, শাহাবাগ, তেজগাঁও, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরাসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাসহ অলিগলিতে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড ঝুলছে। এগুলোর প্রত্যেকটি সরকারি দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নামে রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মলীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী স্বাধীনতা লীগ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, থানা আওয়ামী লীগ, হকার্সলীগ, কৃষকলীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতিলীগ, রিকশা-ভ্যান শ্রমিকলীগ, সড়ক-পরিবহন শ্রমিকলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদের নেতাকর্মীদের নামে।

তবে ব্যানার-ফেস্টুন করার ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, যারা ব্যক্তি স্বার্থে রাজনীতি করে না, একান্ত বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর হয়ে রাজনীতি করেন তারা নিজেদের ছবি না দিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন করবে দলের জন্য, তারা কখনও পিছপা হবে না। অবশ্য কয়েক স্থানে তার ছবি ব্যবহার করে কয়েকজন ছাত্রলীগনেতা ফেস্টুন করেছেন। সরেজমিন দেখা যায়, এলাকাবাসীকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে মিরপুরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোহাম্মদপুর থানা একটি ফেস্টুন লাগিয়েছে। এতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান এবং মোহাম্মদপুর থানার এক নেতার বড় ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

অপরদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রায় সবকটি থানার নেতারা নিজেদের ছবি দিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন করেছেন। এ বিষয়ে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, সংগঠনের নির্দেশনা মেনে চলার বিষয়ে তারা অত্যন্ত কঠোর। যেখানে জানতে পারছেন নেতাকর্মীরা নিজেদের ছবি দিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন করেছে তারা দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনেরই নেতাকর্মীদের পোস্টারে সৌন্দর্যহানি ঘটছে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের আশপাশ। এমন অবস্থা নিয়ে জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের সাথে যুক্তদের মধ্যে বেশ ক্ষোভের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের মধ্যেও ক্ষোভ আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির আশপাশে নেতাকর্মীদের পোস্টারের ছড়াছড়ি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যে লাইনে অবস্থিত, সে লাইনের প্রতিটি বাড়ির সম্মুখস্থ সীমানা প্রাচীর, বাড়িগুলোয় প্রবেশের পথে, এমনকি প্রধান ফটকেও সাঁটানো আছে পোস্টার।

গত কদিনের বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ায় পোস্টারগুলো নষ্ট হওয়ায়, এসব স্থাপনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের পরিবেশও নষ্ট হয়েছে বলতে শোনা গেছে দর্শনার্থীদের মুখ থেকে। এছাড়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত সানতুন রেস্টুরেন্টে প্রবেশের ফটকে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বরাবর এ রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় গেট-সীমানা প্রাচীর, এ রেস্টুরেন্টের বিপরীতে শোভাবর্ধনের জন্য নির্মিত গোলাকৃতির একটি স্থাপনা, এ স্থাপনা বরাবর জাদুঘরের দিকে চটপটি বিক্রয় স্থানঘেঁষা দুটো পিলার পোস্টারের অস্তিত্ব পেয়ে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানা বরাবর অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার আলহাজ্ব মতিউর রহমান চৌধুরীর বাড়ি।

এ বাড়ির প্রবেশ গেটের দুপাশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-পাঠাগার সম্পাদক এমএ হান্নানসহ আওয়ামী লীগের আরও তিন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের পোস্টারের অস্তিত্ব আছে। এ সীমানা বরাবর ‘সারায়ে খাম’ নামক একটি বাড়ির সীমানা প্রাচীরে ওই এমএ হান্নানের পাশাপাশি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. সুলতান মাহমুদ সীমন, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগনেতা জসিম উদ্দিন চৌধুরী, ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসিফুল আলম চৌধুরী আসিফের পোস্টারের অস্তিত্ব দেখা যায়।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ছবি ব্যবহারের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দায়িত্বশীলদের ভূমিকা রাখা উচিত। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক ঈদ ও দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলোতে এ নির্দেশনা মানা হয় না। এটা হতাশা ও দুঃখজনক বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ছবি ব্যবহার করা নিয়ে দলীয়ভাবে আরও কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এগুলো আসলে নেতাদের অতি উৎসাহী অনুসারীরা করে থাকে। তারা নেতার পাশে ছবি ব্যবহার করে নিজেদের প্রচারণায় আনতে চায়। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সবারই সচেতন হওয়া জরুরি।