Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

হকার উচ্ছেদে ব্যস্ত দুই মেয়র

বেলাল হোসেন॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ১৩, ২০১৭, ০৬:০৫ এএম


হকার উচ্ছেদে ব্যস্ত দুই মেয়র

ঢাকা সিটির দুই মেয়র কথার ফুলঝুরিতেই পার করলেন দুবছর এমন মন্তব্য অনেক নগরবাসীর। তবে দৃশ্যমান কিছু উন্নয়নও দেখাতে পেরেছেন তারা; একথাও সত্য। কিন্তু চিকুনগুনিয়া রোগের ভাইরাস বহনকারী এডিশ মশা নিধনে ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত হচ্ছেন। মঙ্গলবার খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার জন্য দুই সিটি করপোরেশন দায়ী।

নগরবাসী বলছেন, মেয়রদ্বয় ঢাকার মানুষের প্রধান সমস্যা চিকুনগুনিয়া রোধে মশক নিধনে সময় কম দিয়ে ঢাকা সিটি পরিচ্ছন্নে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হকার উচ্ছেদের যুদ্ধজয়ে বেশি ব্যস্ত। বিপত্তি ঘটেছে তখনই। এদিকে খেয়াল দিতে গিয়ে ওদিকে খেয়াল দিতে পারেননি। এই সুযোগে এডিশ ও অন্য মশার বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক। খেসারত দিচ্ছেন নগরবাসী চিকুনগুনিয়ার তীব্র ব্যথা ও জ্বরের যন্ত্রণায়।

অথচ ঢাকার অনেক মানুষ বলছেন, হকার উচ্ছেদে তেমন কোনো ফল পাননি মেয়ররা। সকালে উচ্ছেদ তো বিকালেই দখল হয়ে যায়। এই হকার উচ্ছেদে মনোনিবেশ করতে গিয়ে রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া যে বারোটা বাজাল সেই খেয়াল ছিল না দুই মেয়রের। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিশ মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তেমন একটা দেখা যায়নি গত কমাসে। বরং ঢাকায় কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন গণসৌচাগার ও ময়লা ফেলার জন্য বিন দিয়ে প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন তারা।

গণসৌচাগারগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও রাস্তার পাশের বিনগুলোর বেশিরভাগই আর দেখা যাচ্ছে না। টোকাই ও মাদকাসক্তরা তা নিয়ে গেছে। এ অবস্থায় নগরবাসীর অভিমত মেয়রদ্বয় যদি প্রাধান্য দিয়ে এডিশসহ অন্যসব মশা মারায় ওই খাতের টাকা খরচ করতেন এবং হকার উচ্ছেদের দিকে এতটা মনোযোগ নাও দিতেন তাহলে রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ায় হাজার হাজার মানুষের এত কষ্ট পেতে হতো না।

অনেক সমালোচনার পর এখন তারা চিকুনগুনিয়া রোধে মশক নিধনে সক্রিয় হচ্ছেন। কিন্তু এতদিনে তো এডিশ মশা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অনেকটা ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গিয়াছে’ প্রবাদের মতো।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দুমাসে ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ঘটেছে। দুই সিটি করপোরেশন বলছে, আগাম প্রস্তুতি না থাকায় এ মশার বিস্তার ঘটেছে। ছিটানো ওষুধেও দমন হচ্ছে না এডিস প্রজাতির এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস মশা। ফলে চিকুনগুনিয়ায় অতিষ্ঠ এবং আতঙ্ক বাড়ছে নগরবাসীর।

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা মনে করি না যে, পুরোপুরি দায়ী। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতে বাসাবাড়ির ফুলের টব, ছাদে পানি জমে থাকার কারণে এ মশার সৃষ্টি হয়। সুতরাং আমাদের জনবলের দায়িত্বের চেয়ে জনগণকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এটা বাংলাদেশেই একমাত্র না, দক্ষিণ এশিয়ার বেশকটি দেশে দেখা দিয়েছে। চিকুনগুনিয়া এই প্রথম আমাদের দেশে আক্রমণ করেছে। আমরা সেভাবে তৈরি ছিলাম না। তবে আস্তে আস্তে এটা এখন কমে যাচ্ছে। আমরা যথেষ্ট মশক নিধন ওষুধ ছিটাচ্ছি।অপরদিকে বিদেশে থাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। ম্যাসেজ দিয়েও ফল হয়নি।

এদিকে নগরবাসীর অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, আগের মতো ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো এখন আর চোখে পড়ে না। আবার ছিটিয়ে গেলেও সেগুলোতে মশা কতটা মরছে তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

গতকাল সরেজমিন কথা হয় ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর এলাকার ঢাকেশ্বরী রোডের স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। রহমান হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, গত রোববার একবার মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেছি। কিন্তু মশার উৎপাত তো কমেনি। তিনি আরও বলেন, ড্রেনের মধ্যে পানি জমে থাকে, রাস্তার পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এগুলো পরিষ্কার না করলে মশা কমবে না বরং বাড়বে।

এ বিষয়ে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের সুপারভাইজার মো. নুরুল হক আমার সংবাদকে বলেন, মশক নিধনে ওষুধ ক্রয় থেকে শুরু করে সেগুলো কোথায় ছিটাতে হবে তার দেখভাল করে সিটি করপোরেশন। আমি শুধু এখানকার কর্মচারীদের বেতন দেয়া ও অফিসের কাজ করি।

ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে বর্তমানে তাদের ১৯ জন সুপারভাইজার কাজ করছেন। এর মধ্যে ফিল্ডে কাজ করছেন ১৭ জন। ওষুধ ছিটানোর কাজে প্রায় ২২০ জন ক্রু কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুই সিটির জন্য লোকবল অনেক কম। এই লোকবল দিয়ে মশা নিধন অনেকটা কঠিন। বিদেশ সফরে থাকায় দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলালের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে সিটি মেয়রদ্বয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে জনসচেতনতায় সেমিনার করে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া মহামারি আকার ধারণ করেনি, তরব বেশকিছু এলাকায় ছড়িয়েছে। তারা সিটি করপোরেশনের অবহেলার কথাও উল্লেখ করেন। গত মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনেও চিকুনগুনিয়া নিয়ে সাংসদদের মধ্যে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়।

দেশে এ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় কতজন আক্রান্ত হয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আইইডিসিআর এ পর্যন্ত জ্বরের ৮০০টি স্যাম্পল পরীক্ষা করে দেখেছে। এর মধ্যে ৬০৫ জনের চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। এছাড়া মোবাইল ফোনে সাধারণভাবে ৪,৭৭৫ জনের সঙ্গে কথা বলে তাদের মধ্যে ৩৫৭ জন চিকুনগুনিয়ার রোগী বলে প্রমাণ পেয়েছে তারা। অন্যদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যত রোগী আসে তাদের ১১ জনের মধ্যে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা ঢাকা মেডিক্যালে আসেন, তাদের প্রতি তিনজনের একজন চিকুনগুনিয়ার রোগী।

প্রসঙ্গত, চিকুনগুনিয়া প্রথম ধরা পড়ে ১৯৫২ সালে আফ্রিকায়। পরে বিশ্বের অন্য দেশেও এর বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা গেলেও পরে বিচ্ছিন্ন দু-একজন রোগী ছাড়া এ রোগের বিস্তার আর বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়নি বলে আইডিসিআর জানায়।