Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ভিড় হাসপাতালে

আফছার আহমদ রূপক॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ১৪, ২০১৭, ০৭:০৩ এএম


চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ভিড় হাসপাতালে

রাজধানীতে যেমন প্রতিদিনই প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি এ রোগের হাত থেকে নিস্তার নেই শিশুদেরও। উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা চিকুনগুনিয়ায় অসুস্থ শিশুদের নিয়ে ছুটছেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। সবথেকে বেশি চিকুনগুনিয়ার শিশু রোগী আসছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। হাসপাতালের রেকর্ডরুমের তথ্য অনুযায়ী গত ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত ৮৯ জন শিশু চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা শিশু হাসপাতালে এসেছে। তাদের মধ্যে এ রোগে অসুস্থ হয়ে ২৭ মে একদিনেই এসেছিল ১০ জন শিশু। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ভর্তি করেও চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে এসব শিশুর সবাই সুস্থ আছে। একই হাসপাতালের কয়েকজনসহ আরও ৯ জন প্রাপ্তবয়স্কও চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুল আহসান জানান, শিশু হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসা ২০ শিশুর মধ্যে অন্তত ১২ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। শুধু চিকুনগুনিয়াই নয়, গত মাসে তিনটি ডেঙ্গুজ্বরের শিশুরোগীও চিকিৎসার জন্য এসেছিল। এরমধ্যে একটি শিশু ছিল মারাত্মক হেমুরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

তাকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে শিশু আর বড়দের মধ্যে তেমন একটা হেরফের নেই। তবে বড়দের যেমন শরীরের গিরায় গিরায় দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা থাকে, শিশুদের তেমন নয়। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় দুয়েকদিনের মধ্যেই জ্বর ও ব্যথা কমে যায়। সামান্য ব্যথা ও জ্বরের সিরাপ দিলেই চলে। তারপরও শিশুদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা বেশিরভাগ সময় দিনে কামড়ায়। আর শিশুদের অনেকেই দিনে ঘুমায়। তখন অবশ্যই মশারি টানিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, এখনও এ রোগে কেউ মারা না গেলেও যে হারে এবং যেভাবে পরিবর্তিত রূপ নিচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে মৃতুঝুঁকি যে থাকবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়। তাই এখন থেকেই জনগণকেই সচেতন হতে হবে। এডিস মশা গৃহপালিত। তাই ঘরের মানুষকেই এ মশা রোধ করতে হবে। এসির নিচে, ফুলের টবে কিংবা অন্যান্য পরিত্যক্ত পাত্রে স্বচ্ছ পানি জমিয়ে রাখা উচিত নয়।

এদিকে হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা যেসব এলাকা থেকে এসেছে, সে এলাকাগুলো হলো পূর্ব ধনিয়া, নয়ারহাট, গ্রিনরোড, বড় ভাওয়াল কেরানিগঞ্জ, মিরপুর পূর্ব কাজীপাড়া, আগারগাঁও চওতলা গার্মেন্ট, মনিপুরিপাড়া ৬ নম্বর গেট, শেওরাপাড়া, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট গ্রিনসুপার মার্কেট, স্বর্ণাভিলা মিরপুর, সাভার নিউমার্কেট, মিরপুর সাংবাদিক কলোনি, ১৪৯ নম্বর রাজাবাজার, গাজীপুর, পশ্চিম আগারগাঁও, কল্যাণপুর, সোবহানবাগ, তালতলা, আগারগাঁও গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার, মিরপুর ১৪, ইব্রাহিমপুর, পূর্ব রাজাবাজার ফার্মগেট, পীরেরবাগ. নবোদয় হাউজিং মোহাম্মদপুর, পশ্চিম কাফরুল, শ্যামলি, আমিন বাজার, সেগুনবাগিচা, মিটফোর্ড, নবাবগঞ্জ, মহাখালী, মধ্যপাইকপাড়া, খিলগাও, দক্ষিণ পীরেরবাগ, শেখেরটেক, সবুজবাগ, কচুয়া চাঁদপুর, পশ্চিম নাখালপাড়া, লালমাটিয়া, কাজীপাড়া, দয়াগঞ্জ, মিরপুর দারুসসালাম, উত্তরা, মিরপুর, শ্যামলি মোহনপুর, মধ্য বাড্ডা, শ্যামলি আদাবর ও ময়মনসিংহ। কেবল শিশুই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডাক্তার, সাংবাদিক, উকিল, শিশু-বৃদ্ধসহ বয়সের মানুষেরই পিছু ছাড়ছে না এ বেরসিক চিকুনগুনিয়া রোগ। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যাদের অন্যরোগ আছে, তাদেরই চিকুনগুনিয়া বেশি কাবু করছে। যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট, ফুসফুসসহ অন্যান্য সমস্যার রোগীদের এডিস মশা কামড় দিলে চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুজ্বর বেশি অসুস্থ করছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আবহাওয়ার তারতম্যে হঠাৎ বৃষ্টি এবং রোদ হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই পরিত্যক্ত পাত্রে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে এবং বংশ বৃদ্ধি করে। তাই পরিত্যক্ত পাত্র, ফুলের টব, টায়ার, ডাবের খোসা, এসির নিচসহ যেসব স্থানে এডিস মশা বাসা বাঁধে সেগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে, যাতে এডিস মশা ডিম না পাড়ে। এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। রোগটি এমনিতেই সেরে যায়। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুজ্বরের তেমন চিকিৎসা নেই। নেই প্রতিষেধকও। জ্বর ও শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে। তবে সবথেকে বেশি খাওয়া প্রয়োজন পানিসহ তরল খাবার। বিশ্রামও খুবই দরকার। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধই উত্তম। একটু সচেতন হলেই এ দুটি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো পাত্রেই যেন তিন-চারদিন স্বচ্ছপানি জমে না থাকে। শিশুদের দিনে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে গ্রামে যেসব চিকুনগুনিয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তারা ঢাকায় এডিস মশার কামড় খেয়েছিলেন।

জানা গেছে, রাজধানীতে বেশ কমাস ধরে শিশুসহ কয়েকশ মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে চিকুনগুনিয়া নিয়ে। চিকিৎসকরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা বহন করে। এডিস মশা ভোরে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। এডিস মশার কামড়ে এ রোগের প্রকোপ কেবল রাজধানীতেই বেড়েছে। গ্রামে নেই। চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের জ্বর, মুখে অরুচি, মাথাসহ শরীরের গিরায় গিরায় অনেকদিন প্রচ- ব্যথা হওয়ায় ভয় বেশি পাচ্ছে রোগীরা। কারণ এ রোগ সম্পর্কে মানুষের ধারণা কম। বেশি প্রচার হয়েছে ডেঙ্গুজ্বর সম্পর্কে। যদিও ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ ও চিকিৎসা অনেকটা একই রকম। পার্থক্য কেবল ডেঙ্গুজ্বরে গিরায় গিরায় ব্যথা করে না।

দেশে এ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় কতজন আক্রান্ত হয়েছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আইইডিসিআর এ পর্যন্ত জ্বরের ৮০০টি স্যাম্পল পরীক্ষা করে দেখেছে এবং তার মধ্যে ৬০৫ জনের চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করা গেছে। এছাড়া মোবাইল ফোনে সাধারণভাবে ৪,৭৭৫ জনের সঙ্গে কথা বলে তাদের মধ্যে ৩৫৭ জন চিকুনগুনিয়ার রোগী বলে প্রমাণ পেয়েছে তারা। অন্যদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যত রোগী আসেন, তাদের ১১ জনের মধ্যে একজন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা ঢাকা মেডিক্যাল-এ আসেন তাদের প্রতি তিনজনের একজন চিকুনগুনিয়ার রোগী।

প্রসঙ্গত, চিকুনগুনিয়া প্রথম ধরা পড়ে ১৯৫২ সালে আফ্রিকায়। পরে বিশ্বের অন্য দেশেও তার বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা গেলেও পরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি রোগী ছাড়া এ রোগের বিস্তার আর বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়নি বলে আইইডিসিআর জানায়।