প্রিন্ট সংস্করণ॥ নুর মোহাম্মদ মিঠু
জানুয়ারি ৬, ২০১৮, ০৭:০০ পিএম
আফজাল হোসেন ইমন রাজধানীর এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম। যিনি ইয়াবা ব্যবসার চক্রের সাথে জড়িয়েছেন নিজের স্ত্রী, ছেলে ও দশম শ্রেণি পড়ুয়া দুই মেয়েকে। সবার অংশগ্রহণে এ ব্যবসার আয় দিয়েই আয়েশি জীবনযাপন করত ইমন ও তার স্ত্রী-সন্তানরা। এমন একটি ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার পরও এলাকাবাসী জানত পুরো পরিবারটিই একটি পরহেজগার পরিবার। সম্প্রতি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হাতে ইমন (৫০) ও তার ছেলে সালাউদ্দিন প্রিন্স (২০) গ্রেপ্তার হওয়ার পর আঁতকে ওঠেন স্থানীয়রা। গ্রেপ্তারের পর থেকেই আয়েশি জীবন ছেড়ে কারাগারেই রয়েছে ইমন। শক্ত কোনো মামলা না হওয়ায় এবং মজবুত সাক্ষ্যের অভাবে এর আগেও বেশ কবার গ্রেপ্তার হয়ে খুব কম সময়ের ব্যবধানে বেরিয়ে আসেন ইমন। তবে এবার বেশ শক্তভাবেই তাকে ধরা হয়েছে বলে দাবি করেছে সিআইডি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ পরিবারটির ইয়াবা ব্যবসার শুরু থেকে শেষ এবং পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনতে রাখা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে। খুব কম সময়ের মধ্যেই ইমনের এ ব্যবসার চক্রের সকল সদস্যকে আইনের আওতায় আনারও দাবি করছে সিআইডি। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, পুরো পরিবারটিই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাদকের টাকা লেনদেন করত। সিআইডি ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিষয়টি তদন্ত করছে। রাজধানী মিরপুরের ৪৭১/সি, পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় তিন রুমের একটি বিশাল বাসায় বসবাস করছে ইয়াবা ব্যবসায়ী এ পরিবারটি।। প্রতিটি রুমে সাজানো দামিদামি জিনিসপত্র। ড্রইং রুমে শোভা পাচ্ছে ৫২ ইঞ্চি এলইডি কালার টেলিভিশন, নামি কোম্পানির দামি ফ্রিজ, দামি কাঠের নকশা করা খাট, কারুকার্য করা সোফা। নান্দনিকতার জন্য আরো রয়েছে দেশি-বিদেশি দামি আসবাবপত্র, রঙিন ঝলমলে ঝাড়বাতি ও মেঝেজুড়ে লাল কার্পেট। এককথায় বিলাসী জীবনের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার কোনো কিছুই নেই বাদ। চোখ ধাঁধাঁনো বিলাসী এমন জীবনযাপন করেন মিরপুরের ইয়াবা ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন ইমন। ইয়াবা ব্যবসায়ী ইমন চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার নীলকমল (মোল্লা বাড়ি) গ্রামের মৃত এম আমানুল্লার ছেলে। পড়াশুনা করেছেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকলেও সর্বশেষ বাসাভাড়া নেন মিরপুর এলাকায়। তার দৃশ্যমান কোনো আয় না থাকলেও বিলাসী জীবনযাপন করতেন তিনি। প্রতি মাসে ২০ হাজারের উপরে বাসাভাড়া দিতেন। সন্তানরা কোনো কিছু চাওয়া মাত্রই তা পূরণ করতেন। ইয়াবা ব্যবসার জন্য প্রতি মাসেই কক্সবাজারে যেতেন ইমন। সঙ্গে প্রায়ই স্ত্রী ও সন্তানদের নিতেন। কিন্তু কীভাবে তার উত্থান, জেলে থাকায় সে বিষয়ে সিআইডি কিছু জানাতে পারেনি। ইমন খুব চতুর ছিলেন। মুখভর্তি দাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে এলাকার মানুষের কাছে নামাজি সাজতেন। বেশিরভাগ সময় মসজিদেই পড়ে থাকতেন। কিন্তু এর আড়ালে যে তিনি ইয়াবা ব্যবসা করতেন তা এলাকার কেউ বুঝতেই পারতেন না। সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, ইমন প্রায় আট থেকে দশ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্রতি সপ্তাহে তিনি টেকনাফের ভুট্টো নামের এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাইকারি দরে ইয়াবা আনতেন এবং বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। পরে তা মিরপুর, শেওড়াপাড়া, সাভার, গাজীপুর, বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতেন। বড় ছেলে সালাউদ্দিন প্রিন্স, স্ত্রী সাদিয়া আফরোজ ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া দুই মেয়ে তার এ কাজে সহযোগিতা করত। ইমন ইয়াবা ব্যবসার কারণে ঘনঘন বাসা পরিবর্তন করতেন। সর্বশেষ তিনি মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসায় ওঠেন। ইমনের স্ত্রী সাদিয়া আফরোজের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে আফজাল হোসেন ইমনের পারিবারিক জীবন। যাদের প্রত্যেকের হাতে শোভা পায় বর্তমান যুগের দামি মোবাইল অপপোর আধুনিক মডেলসহ নামিদামি কোম্পানির বিভিন্ন ব্রান্ডের মোবাইল, যার বাজার মূল্য ৪০-৬০ হাজার টাকা। বড় ছেলে ব্যবহার করেন ইয়ামাহা এফজেড, সুজুকি ব্রান্ডের মোটরসাইকেল, যার বাজার মূল্য আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। কয়েক মাস অন্তর বদলে যায় সেই মোটরসাইকেলও। কেবল তা-ই নয়, পরিবারের সদস্যদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রতি মাসে রয়েছে বিমানে কক্সবাজার ভ্রমণ। আর এ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ইমন পুরো পরিবারকেই ব্যবহার করতেন তার অনৈতিক ব্যবসায়। যদিও তার পুরো পরিবার যে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত তা দেখেও বোঝার উপায় নেই। কারণ ইমন ও তার স্ত্রীর বেশভূষা দেখে এলাকায় তাদের মার্জিত ও পরহেজগার হিসেবে জানে। ইমনের স্ত্রী ও দুই মেয়ে পর্দা ছাড়া বাসা থেকে বের হন না। ইমন ও তার পুরো পরিবারের সদস্যরা যে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বিষয়টি সম্প্রতি এক মানি লন্ডারিং মামলায় সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ প্রসঙ্গে ইমনের স্ত্রী সাদিয়া আফরোজ সিআইডিকে জানিয়েছেন, এর আগে ইমন তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। প্রত্যেকবারই গ্রেপ্তার হয়ে মাস খানেক জেল খাটার পর আবার ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে আসেন। তারপর আবার শুরু করেন ব্যবসা। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন ইমন। তারপর থেকে তিনি কারাগারে। ইমন গ্রেপ্তারের পর তার ছেলে প্রিন্স ও স্ত্রী এলাকার মানুষকে বলতেন, তিনি ভারতে বেড়াতে গেছেন। ইমনের বড় ছেলে সালাউদ্দিন প্রিন্সকে গত ২ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে সিআইডি। ওই সময় মিরপুরের বিকাশ এজেন্ট ও ভিশন টেলিকমের স্বত্বাধিকারী স্বপনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এই স্বপনই ইমনের ইয়াবা কেনার টাকা বিকাশ করতেন টেকনাফে। গত মঙ্গলবার স্বপনকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে ১০টি সচল মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। যেসব নম্বর থেকে নিয়মিত ইয়াবার অর্থ স্থানান্তর করা হতো, সে ধরনের ২৫০টি নম্বরের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৪নং ওয়ার্ডের ৬নং ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তফা কামাল হাওলাদার বলেন, তিনি যে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী তা কেউ জানত না। তাছাড়া তাকে তেমনভাবে কেউ চিনতও না। কারণ তিনি ও তার পরিবারের কেউ কখনো কারো সাথে তেমন মিশতেন না। এলাকাবাসী জানায়, ইমনের বড় ছেলে সালাউদ্দিনের ডাকনাম প্রিন্স। তাকে এলাকায় সবাই মডেল বয় হিসেবে চেনে। প্রিন্স মিরপুর বাঙলা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার ছিল বন্ধু-বান্ধবের বিশাল কলেবর। এরই ফাঁকে দেখতেন বাবার ইয়াবা ব্যবসা। সে সবসময় ধনীর সন্তানের মতো চলাফেরা করত। ইমন বর্তমানে যে বাসায় ভাড়া থাকেন সে বাড়ির দেখভালকারী বদরুল আলম খোকন বলেন, ইমন সাহেব গ্রেপ্তারের পরই তার পরিবারকে বাসা ছাড়ার নোটিস দেয়া হয়েছে। তিনি যে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী, আগে জানলে তাকে বাসা ভাড়াই দিতাম না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল আজাদ বলেন, ইমন ইয়াবার টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন। তার ছেলেকে গ্রেপ্তারের পর ইমনকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। শিগগিরই তাকে ও তার ছেলেকে রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হবে। রিমান্ডে আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন তিনি। তিনি আরো জানান, যেসব সিম জব্দ করা হয়েছে সেগুলোর গড়ে অন্তত ১০ হাজার টাকা করে মোট ২৫ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া চক্রটির কাছ থেকে ২১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ইমন প্রতিবার ধরা পড়ার পর জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকে ধরার পর মানি লন্ডারিংয়ের মতো শক্ত মামলা দেয়া হয়নি বলেই এ ব্যবসা থেকে তাকে বিরত রাখা যায়নি। মাদকের মামলায় মাস খানেক সাজা হওয়ার পরই সে বেরিয়ে আসে। তার পক্ষে তেমন সাক্ষী না থাকায় সাজাও হত না। তবে এবার তাকে শক্তভাবেই ধরা হচ্ছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ইমন খুব চতুর। তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ চক্রের অন্য সদস্যকে গ্রেপ্তারের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় গোয়েন্দা নজরদারি রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, পূর্বেও বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন ইয়াবা ব্যবসায়ী বাবা-ছেলে ইমন ও প্রিন্স। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর বাবা ইমনকে ২০০ পিস ইয়াবাসহ এবং ২ জানুয়ারি ছেলে প্রিন্সকে গ্রেপ্তার করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছে।