Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫,

ব্যক্তিগত সহকারীর এত সম্পদ!

প্রিন্ট সংস্করণ॥ ফারুক আলম

ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৮, ০৬:৪০ পিএম


ব্যক্তিগত সহকারীর এত সম্পদ!

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) শাহাবুদ্দিন মাতুব্বরের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সংস্থার মালামাল ক্রয় ও সরবরাহে কমিশন আদায়, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করে নিন্মমানের মালামাল সংগ্রহ, অফিসের গোপন তথ্য আগেই ঠিকাদারকে জানিয়ে দেওয়া, বিনা টেন্ডারে মালামাল ক্রয়সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এই ব্যক্তিগত সহকারীর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে বিভিন্ন সময় একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেয়রসহ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগে আরও বলা হয়, এভাবে বছরের পর বছর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে শাহাবুদ্দিন মাতুব্বর বর্তমানে বেশ কয়েকটি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। মিরপুরের বড়বাগ বসতী হাউজিংয়ের ১ নং রোডের ৩ নম্বর বাড়ির তয় তলায় সি-২ ফ্লাটটি তিনি ক্রয় করেছেন। তিনি চিড়িয়াখানা রোড সংলগ্ন বেড়িবাধ এলাকায় আট কাঠা জমি কিনেছেন। এছাড়া তিনি একটি সাদা রঙের নোয়া গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৫৬৮) মালিক। আছে আরো অনেক সম্পদ।
জানা গেছে প্রতিবছর ভাণ্ডার বিভাগ থেকে ডিএসসিসি’র ২১টি বিভাগের বিভিন্ন প্রকারের তিনশতাধিক মালামাল সংগ্রহ করতে হতে হয়। এই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজই হচ্ছে প্রয়োজনীয় সকল মালামাল ক্রয়, মজুত ও সময়মতো চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা। এ জন্য ডিএসসিসির বাজেটে প্রতি অর্থবছরের জন্য এখাতে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এই মালামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, কাজের বিনিময়ের নির্দিষ্ট হারে কমিশন নেয়া ও নিন্মমানের মালামাল গ্রহণ করেন ওই পিএ শাহাবুদ্দিন। সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার বিষয়টি জানলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
সম্প্রতি তার অনিয়মের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের চারটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নানা অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সংস্থার মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দফতরে লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ফোর পি লজিস্টিকস, মেসার্স স¤্রাট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানী লিমিটেড, মেসার্স মালিহা এন্টারপ্রাইজ ও মুক্তা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। তারা পাঁচ পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগটি মেয়রের বরাবর দাখিল করেন ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই। অজ্ঞাত কারণে অভিযোগটি ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঠিকাদার বলেন, প্রতিটি কাজেই তাকে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ দিলে কাজ নিয়ে দেন। অনেক সময় অফিসের গোপন তথ্য অন্যান্য ঠিকাদরকে সরবরাহ করেন। এছাড়া মালামাল সরবরাহ করার সময় বিভাগীয় প্রধানের স্বাক্ষরের কথা বলে আবারো ঘুষ দাবি করেন। এর পর কাজ নিয়ে তারা অত্যন্ত নিন্মমানের মালামাল সরবরাহ করেন। ব্যবহার যোগ্য না হওয়ায় অনেক সময় বিভিন্ন দফতর থেকে সেই মালামাল ভাণ্ডার বিভাগে ফেরতও দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ডিএসসিসির অভিযুক্ত পিএ শাহাবুদ্দিন মাতুব্বরের কাছে আমার সংবাদের প্রতিবেদক ফোন দেন। শাহাবুদ্দিন ফোন রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় শোনা মাত্রই ফোন রেখে দেন। এরপরেও কয়েকবার চেষ্টা করলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি। এর আগেও ২০১৪ সালে ১২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা অভিযোগ করে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছিল। সে সময়ও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগে জানা যায়, ডিএসসিসির প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তার পদটি প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের। এ পদে স্থায়ী কোনো কর্মকর্তা নেই। ফলে দু’এক বছর দায়িত্ব পালন করার পর আবার তারা বদলি হয়ে চলে যান। কিন্তু প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারীর পদটি স্থায়ী। মূলত এ দপ্তরের সব কাজ তার হাত দিয়েই হয়। কিন্তু গত ১০ বছর ধরেই এই পদে কর্মরত আছেন শাহাবুদ্দিন মাতুব্বর। তিনি পুরো দপ্তরটির সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন। যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঘুষ ছাড়া তিনি কোন কাজে হাত দেন না। ফাইলও পৌঁছাননা প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তার টেবিলে। তবে এই কাজে তার বিভাগীয় প্রধানের সহায়তার অভিযোগও উঠেছে। ফলে বেপরোয়া হয়ে পড়েন তিনি। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা সাখাওয়াৎ হোসেন ফোন রিসিভ করেননি। সাখাওয়াৎ হোসেন আগামী মাসের দিকে এই দায়িত্ব থেকে অন্যত্র যাওয়ার কথা রয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী বিভাগের ভাণ্ডার রক্ষকদের কেনাকাটার বিষয়টি দেখার কথা। অন্যান্য ভাণ্ডার রক্ষকদের অভিযোগ, ডিএসসিসিতে বর্তমানে তিন জন ভাণ্ডার রক্ষক থাকার পরও তাদের কোন কাজ দেওয়া হয় না। শাহাবুদ্দিন মাতুব্বর সব কেনাকাটা নিজেই সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে পিপিআর অনুসরণ করেন না। তিনি বর্তমানে একজন ভাণ্ডার রক্ষকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে একই পণ্য দুইবার ক্রয় দেখিয়ে বিল উত্তোলন করেন তিনি। শুধু তায় নয়, প্রতিমাসে জরুরি ভিত্তিতে কেনাকাটার জন্য ইমপ্রেসড মানি বাবদ এক লাখ টাকা করে প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তার নামে বরাদ্দ থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ভুয়া ভাউচার তৈরি করে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ঠিকাদারদের ওই অভিযোগ আরও বলা হয়েছে, ডিএসসিসির ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেট বই ছাপানোর কাজেও ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। ১০০ জিএসএম আর্ট পেপার ও ৩০০ জিএসএম আট কার্ডের কভার বাজেট বই ছাপাতে সর্বোচ্চ প্রতিটি ৬০ টাকা খরচ হওয়ার কথা, অথচ এ বই ছাপানো হয়েছে প্রতিটি ২৮৫ টাকা দরে। যাতে প্রতিটি বই থেকে ২১৫ টাকা হিসেবে এক হাজার বই ছাপিয়ে দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন।
তবে সবচেয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে মশার ওষুধ কেনাকাটায়। প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার এই ব্যক্তিগত সহকারী কোন প্রকার উন্মুক্ত টেন্ডার বা ই-টেন্ডার ছাড়াই নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডকে কার্যাদেশ দিয়েছেন। এ কোম্পানির মাধ্যমে ডিএসসিসি এ পর্যন্ত মোট ৩২ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে। এজন্য ডকইয়ার্ডের মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে দুই শতাংশ হারে ৬৪ লাখ টাকা কমিশন হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, মশার ওষুধ কেনাকাটায় কমিশনের ১৩ শতাংশ পান পিএ । আর বাকীটা ওই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির ক্রয় বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন মাতুব্বরের নানা হয়রানির শিকার ওই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।