Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২১ মে, ২০২৫,

একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প: বাড়ছে ঋণখেলাপির পরিমাণ

প্রিন্ট সংস্করণ॥ফারুক আলম

মে ২, ২০১৮, ০৬:১৬ পিএম


একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প: বাড়ছে ঋণখেলাপির পরিমাণ

গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে একটি বাড়ি একটি খাবার প্রকল্প চালু করলেও দরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে এ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কিছু অসাধু কর্মকর্তা অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছেন। ফলে সরকারের প্রকৃত পরিকল্পনা কাজে আসছে না। প্রকল্পটির অবস্থা এমন নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, মূলধন খুঁজে পাওয়াটাই ভার। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের বিনিয়োগ করা অর্থের কোনো হদিস থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পটির এমন নাজুক অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার পরও নতুন করে প্রায় ৬ হাজারের উপরে জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তৃতীয় ধাপে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মেয়াদ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পেও ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়লেও সম্প্রসার যাচাই হয়নি। প্রকল্পের সম্প্রচার যাচাই-বাছাই না করেই প্রকল্পে বর্তমানে কর্মরত জনবল ও ভবিষ্যতে যারা এ প্রকল্পে চাকরি পাবেন তাদের মধ্যে থেকে সিনিয়র ও সততার ভিত্তিতে ক্রমশেই ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে’ স্থানান্তর করা হবে। আর যেসব কর্মকর্তা মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন তাদের জায়গা ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে’ হবে না। এসব শর্ত থাকার পরও মাঠপর্যায়ে এ প্রকল্পের কর্মরত লোকজন কৌশলে অর্থ লুটপাট করছে। হতদরিদ্রদের ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও মাঠকর্মীরা যোগসাজশ করে গ্রামের ধনী ব্যক্তিদের ঋণ দিচ্ছে। এতে গরিবরা গরিবই থেকে যাচ্ছে আর ধনী ব্যক্তিরা আরও ধনী হচ্ছেন।একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে নড়াইল সদর উপজেলায় কর্মরত ছিলেন আনিকা বিশ্বাস। তার বিরুদ্ধে ২৪ লাখ টাকা আর্থিক তহবিল তসরুপের অভিযোগ উঠেছে। নাগেশ্বরী শাখায় ৯৫ শতাংশই ঋণ খেলাপি। তজমুদ্দিন শাখা ভোলায় ৯২ শতাংশ ঋণ খেলাপি। এছাড়া পাংশা উপজেলা রাজবাড়ী শাখার ম্যানেজার ও কম্পিউটার অপারেটর ৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ শাখাও ৯৪ শতাংশ ঋণ খেলাপি। প্রতিটি শাখায় কমবেশি ঋণ খেলাপির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। প্রকল্পের অর্থ কালেকশন করে ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু মাঠপর্যায়ে সুপারভাইজার কালেকশনের অর্থ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা জমার বিষয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল শাখার কম্পিউটার অপারেটর কাম হিসাব সহকারী ইকবাল হক আমার সংবাদকে বলেন, সদস্যদের কাছ থেকে টাকা কালেকশন করে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা সহজে জমা দেওয়া যায় না। কারণ এক সদস্য থেকে আরেক সদস্যের দূরত্ব বেশি। যাতায়াতের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। হেঁটেই কিস্তি কালেকশন করতে হয়। এতে সময় লেগে যায়। আবার সদস্যদের কাছ থেকে টাকা কালেকশন করে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে এলে দেখা যায় বিদ্যুৎ নেই অথবা ব্যাংকের সার্ভারের সমস্যা। এ বিষয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন) প্রণব কুমার ষোঘ সত্যতা স্বীকার করে আমার সংবাদকে বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ব্যাংকের সার্ভারে সমস্যা ছিল। তবে তৃতীয় ধাপে যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে সেখানে সার্ভারের সমস্যা থাকবে না। সার্ভারের কাজ চলছে।সূত্র মতে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ১ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা মাত্র ২ শতাংশ সুদে ব্যাংক এশিয়া, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে জমা রয়েছে। বিপুল অর্থ অন্য ব্যাংকে রাখলে সুদের হার ৫ শতাংশের বেশি আসত। প্রকল্প বিলুপ্তি হওয়ার আগেই দ্বিতীয় ধাপের এ অর্থ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক চাইলে তাদেরকে প্রায় ২১৫ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব আকবর হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, একটি বাড়ি একটি খামারের প্রথম ধাপে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে মাঠকর্মীরা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে দরিদ্র লোকজনকে বঞ্চিত করে গ্রামের ধনী ব্যক্তিদের ঋণ দিয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে কিছুটা থাকলেও সেটি বর্তমানে আর নেই। আমরা নিয়মিত মাঠপর্যায়ে গিয়ে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। এত বড় প্রকল্প সেখানে অনিয়ম থাকবে সেটিই স্বাভাবিক। আমরা বসে নেই, অনিয়মের তদন্ত চলছে।প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক প্রণব কুমার ষোঘ আরও বলেন, দ্বিতীয় ধাপে ঋণ খেলাপির তথ্য একটি বাড়ি একটি খামারে নেই। এগুলো পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে পাবেন। নতুন করে তৃতীয় ধাপে জনবল নেওয়া হচ্ছে সেগুলো মাঠে কাজ করলে তখন এ ব্যাপারে ঋণ খেলাপির তথ্য পাবেন। দ্বিতীয় ধাপে ঋণ খেলাপির তথ্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে দেওয়ার পর আমাদের কাছে আর তথ্য নেই।ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সঙ্গে থাকা একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, সরকার উন্নয়নের নামে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে সরকারি কর্মকর্তাদের লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেয়। এসব প্রকল্প জনগণের উন্নয়নের নামে করা হলেও এর দায়িত্বে যারা থাকেন তারাই আগে নিজেদের আখের গোছান। অথচ বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা এদেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হয়। ঠিক সেই রকমই একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি। এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই জনগণ এর সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা পার্বত্য এলাকার আলমগীর হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের একটি বাড়ি একটি খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কাজ করতে হচ্ছে। এক সঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাজ করলেও বেতন দেওয়া হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এতে আমাদের পরিশ্রম বাড়লেও বঞ্চিত হচ্ছি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে। পার্বত্যাঞ্চল দুর্গম ও পাহাড়ি এখানে জনবসতি খুব কম। এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে কষ্ট বাড়লেও সুযোগ বাড়েনি।পুরাতন সমিতির ম্যানেজারদের সম্মানি ভাতা বন্ধ হওয়ার পর বেশিরভাগ ম্যানেজার তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। ভাতা না পাওয়ায় তারা এ দায়িত্বে অনীহা প্রকাশ করছে এবং নতুন কোনো সদস্যও এ দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়। তাদের দায়িত্ব কেবল প্রয়োজনীয় কিছু স্বাক্ষর প্রদান করা। ফলে মাঠ সহকারীদেরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজারদের ভূমিকা নিতে হয়। যা মাঠ সহকারীদের কাজের সার্বিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন বরিশাল হিজলা এলাকার দায়িত্বে থাকা নাইম খান।এর আগে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের বিষয়ে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির মজুমদার বলেন, এ প্রকল্পের সমিতির অডিট হয় না, এজিএম হয় না, নির্বাচন হয় না এবং সমিতির নিজস্ব কোনো তহবিল গঠিত হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় এটি আরও দুর্বল হবে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পর্যালোচনা করে দেখিয়েছে, প্রকল্পে প্রতি সমিতিতে কৃষি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপ্রাণী পালন, নার্সারি ও ফলচাষ বিষয়ে স্বেচ্ছাকর্মী সৃজনের জন্য ২ লাখ ২ হাজার ৬৩৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সংস্থান ছিল। কিন্তু মাত্র ৬৫ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনীতে ১ লাখ সমিতির (পুরাতন ৪০ হাজার এবং প্রস্তাবিত ৬০ হাজার) জন্য ৫ লাখ সদস্যকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা সম্ভবপর নয় বলে মিহির মজুমদারের দাবি। প্রকল্পের সমিতিতে বর্তমানে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা ঋণ আছে। ঋণ আদায়ের হার কত তা কেউ জানে না, এমনকি প্রকল্প অফিসও জানে না। কোনো তদারকি ব্যবস্থাও নেই। উল্লেখ্য, সারাদেশে একটি বাড়ি একটি খামারে ৬৭ হাজার ৭৫৭টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি আছে। এরমধ্য থেকে প্রায় ৩৩ লাখ পরিবার সহযোগিতা পাচ্ছে। এসব পরিবার ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সমিতিতে ১ হাজার ২২১ কোটি টাকার বেশি জমা রেখেছে এবং সরকার ১ হাজার ২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে দিয়েছে। এসব অর্থ গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা বঞ্চিত। উল্টো গ্রামের স্বাবলম্বী পরিবারগুলো এ প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে আরও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।