প্রিন্ট সংস্করণ॥কাওসার আজম
জানুয়ারি ২১, ২০১৯, ০৬:৪২ এএম
প্রায় ৩ মাস আগে ব্রুনাই যান মনসুর আলী। ইয়া ঝি নামের চাইনিজ মালিকের শারিকত ইয়াং ফু হিন কোম্পানি তাকে ভিসা দেয়। সেখানে যাওয়ার পর মালিক ইয়া ঝি আরেক চাইনিজ মালিকের কোম্পানিতে স্থানান্তর করে দেন মনসুরকে। পোলাও মোয়ারা বাছার নামে ব্রুনাইয়ের সাগরঘেরা দ্বীপের একটি অয়েল রিফাইনারিতে ট্রাক চালাচ্ছিলেন মনসুর। কোনো ছুটিছাটা নেই। ওই দ্বীপ এলাকা থেকে বের হওয়ার সুযোগও নেই। একপর্যায়ে তার গলায় ঘা দেখা দেয়। দাঁতের ইনফেকশন। সবমিলিয়ে ব্যথায় কাতর মনসুর আলী। মালিকের কাছে বারবার ছুটি চেয়েও পান না তিনি। চিকিৎসাও হয় না। প্রচ- ব্যথায় ট্রাকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন তিনি। মালিকের এক কথা ছুটি নেই। বাঁচো আর মরো, কাজ করতে হবে। কিছুদিন আগে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে ট্রাকের চাবি মালিকের লোকের কাছে দিয়ে চিকিৎসার জন্য চলে যান। ভর্তি হন হাসপাতালে। ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বিষয়টি জানান মনসুর। ইন্স্যুরেন্স সুবিধাবাবদ তাকে ১৬শ ডলার এবং বকেয়া বেতন বাবদ ১৭শ ডলার দিতে ওই অয়েল রিফাইনারি কোম্পানির মালিক মি. বেন ও মি. সুইকে চাপ দেয়া হয়। কিন্তু, তারা এই অর্থ দেওয়া তো দূরে থাক উল্টো মনসুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন তিনি ৪ দিন তাদের ট্রাক দিয়ে অন্য মালিকের মালামাল বহন করেছেন। তাই মনসুরের এই পাওনা আটকে দেন চাইনিজ ওই দুই মালিক। তার বিরুদ্ধে অন্য মালিকের মালামাল বহনের অভিযোগ আনা হলেও ব্রুনাই বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইং এটির কোনো সত্যতা পায়নি। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি সুস্থ হয়ে মনসুর মূল মালিক ইয়া ঝি’র কোম্পানিতে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে ইন্স্যুরেন্স সুবিধা ও বকেয়া টাকা দিতে চাপ দিতে থাকেন। তার সঙ্গে আরও দুই বাংলাদেশি রাসেল ও আরিফুর রহমানও তাদের বকেয়া বেতনের জন্য চাপ দিতে থাকেন। এর মধ্যে আরিফ ১২শ ডলার ও রাসেল ২ হাজার ডলার বকেয়া বেতন পান। গত সপ্তাহে বকেয়া বেতনসহ পাওনাদি দিতে চাপ প্রয়োগ করার এক পর্যায়ে মূল নিয়োগকর্তা ইয়া ঝি এই তিজনকে মধ্যরাতে জোর জবরদস্তি করে কোম্পানি থেকে বের করে দেন। পাশের একটি মার্কেটের ফুটপাতে রাতযাপন করতে হয় তাদের। ব্রুনাই বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েলফেয়ার অফিসার আবু নাঈম এই প্রতিবেদককে গতকাল এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, দু:খের বিষয় হলো এ তিন বাংলাদেশিকে রাতে জোর করে বের করে দেয়ার জন্য লাঠিয়াল হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এক বাংলাদেশি। মুক্তার বেপারি নাম, বাড়ি রাজবাড়িতে।জানা যায়, চাইনিজ মালিক ইয়া ঝি’র কোম্পানিতে কাজ নেই। এরপরও প্রায় ৫শ শ্রমিক রয়েছে তার অধিনে। এসব শ্রমিককে বিভিন্ন মালিকের কাছে সাপ্লাই দেন তিনি। ৩-৪ লাখ টাকা খরচ করে ব্রুনাইতে গিয়ে ঠিক মতো কাজ পান না শ্রমিকরা। মাসের পর মাস বকেয়া থাকে বেতন। ঠিকমতো খাবারও দেয়া হয় না তাদের। এরপরও বিপুল টাকা খরচ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠাতে সক্রিয় একটি চক্র। রাজবাড়ির মুক্তারও এই শ্রমিক নেওয়ার কাজ করেন দীর্ঘদিন ধরে। এসব শ্রমিক নিয়ে ব্রুনাইয়ের চাইনিজ মালিক ইয়া ঝির কোম্পানিতে দেন। আর তারপর শ্রমিকদের অন্য মালিকের কাছে সাপ্লাই দেন তিনি। এভাবেই চলছে অমানবিকতা। বেতন-ভাতা চাইলে নেমে আসে নির্যাতন। এতে মূল লাঠিয়াল বাংলাদেশি মুক্তার। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মারধর করা, কারখানা থেকে বের করে দেয়াসহ জুলুম-নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে শ্রম উইং। অনেককে আবার পিটিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ারও অভিযোগ আছে।
প্রায় একই অমানবিকতার শিকার হয়েছেন অন্য দুই বাংলাদেশি মাহফুজুর রহমান ও ওমর ফারুকের ক্ষেত্রে। নূর ইসলাম নামে নোয়াখালীর এক ব্যক্তি তাদের অবৈধভাবে ব্রুনাইতে নিয়ে যায়। একেকজন প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ করে ব্রুনাই গিয়ে তিন মাসে কোনো কাজ পায়নি। তাদের ব্রুনাই নিয়ে পালিয়ে থাকে দালাল নুর ইসলাম। নিরুপায় হয়ে মাহফুজ ও ফারুক রাস্তায় আশ্রয় নেন। দেশে ফিরতে হচ্ছে তাদের। ব্রুনাই বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েলফেয়ার অফিসার আবু নাঈম এই প্রতিবেদককে বলেন, শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়। ব্রুনাইতে কাজ না পেয়ে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে রাস্তায় রাত কাটানোর ঘটনা অহরহ ঘটছে।ব্রুনাই বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (লেবার) জিলাল হোসেন জানান, সম্প্রতি ২৯টি কোম্পানি ভিসা অ্যাটাচটেশনের জন্য আমাদের কাছে আবেদন করেছে। তাদের বিভিন্ন হারে শ্রমিকের ভিসা দেওয়া হয়েছে। শ্রম উইং অ্যাটাচটেশন করার আগেই যাচাই বাছাই করে থাকে। কিন্তু সেখানে দেখা গেছে এসব নামে কোনো কোম্পানিই নেই। অফিস নেই। টাকা দিয়ে ভিসা বের করেছে একটি চক্র।তিনি আরও জানান, একটা ভিসা বের করতে ৬-৭শ ডলার খরচ হয়। বিক্রি হয় ন্যূনতম ২ হাজার ডলার। ১৩শ ডলার বা এক লাখ টাকাই লাভ। এ ধরনের ব্যবসা করে যাচ্ছে বাংলাদেশি কথিত প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে আমরা ব্রুনাই লেবার ডিপার্টমেন্টকে লিখেছি। কিন্তু, অ্যাকশন হয় না।
দূতাবাস সূত্র জানায়, সম্প্রতি শ্রম উইংয়ের হাতে ৪০ জনের মতো বাংলাদেশি লেবারের তালিকা এসেছে। যাদের এক বছর থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত বেতন হয় না। তাদের বকেয়া বেতনের পরিমাণ ১ লাখ ২২ হাজার ডলার বা প্রায় ৭০ লাখের ওপর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্রুনাইয়ে একজন শ্রমিকের বেতন দিনে ১৮ ডলার গড়ে। কিন্তু, সেটি পান না তারা। এর চেয়ে কম বেতন দেওয়া হলেও মাসের পর মাস বেতন বকেয়াই থেকে যাচ্ছে। বেতন আটকে রাখছে কোম্পানির মালিকরা। শ্রম উইংয়ের কর্মকর্তারা দেনদরবার করে গতবছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩১০ জনের কাছ থেকে বকেয়া বেতন আদায় বাবদ ৮১ লাখ ২২ হাজার ৭২০ টাকা আদায় করেছে। এসব বিষয় নিয়ে ব্রুনাই লেবার ডিপার্টমেন্টকে জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেও অভিযোগ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।