Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৩ মে, ২০২৫,

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ঘুষ-বাণিজ্যের সেবা কেন্দ্র

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

জানুয়ারি ২৭, ২০১৯, ০৬:০৯ পিএম


জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ঘুষ-বাণিজ্যের সেবা কেন্দ্র

দেশে সরকারিভাবে হৃদরোগ চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি, ঘুষ-বাণিজ্য ও সিন্ডিকেটের কবলে জর্জরিত এ হাসপাতাল নিজেই এখন ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’। হাসপাতালটি ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসাসেবা। চলছে সেবার নামে নৈরাজ্যও। ফলে ভুক্তভোগী রোগীদের কাছে হাসপাতালটি এখন ঘুষ-বাণিজ্যের সেবা কেন্দ্র হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। ঘুষ-বাণিজ্য এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে যে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর মৃত্যু হলে তার ডেথ সার্টিফিকেট পেতেও ঘুষ দিতে হয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের। রোগীদের জন্য বরাদ্দ এক-একটি বেড দিনে ৩-৪ বার বিক্রি হয়। বলতে গেলে দুর্নীতির কারণে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হৃদরোগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রোগের চিকিৎসাসেবা নিয়ে হাসপাতাল কর্মচারীদের নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজনরা। সরকারি হাসপাতাল হলেও অসৎ কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়তই এখানে ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হতে হয় চিকিৎসাসেবা প্রার্থীদের।নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গত বছরের শেষের দিকে (২০ অক্টোবর) অভিযানও চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে সব অনিয়ম-দুর্নীতির দৌরাত্ম্য ও ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণও পায় দুদক কর্মকর্তারা। দুদকের সহকারী পরিচালক ফারজানা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে ৪ ঘণ্টাব্যাপী ওই অভিযান পরিচালিত হয়। ওইসময় কারিগরি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ও অবহেলার কারণে রোগীদের মৃত্যু এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার বিষয়ে হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এমআর সিজারকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন দুদক কর্মকর্তারা। দুদক কর্মকর্তারা সেসময় গণমাধ্যমকে জানান, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে জীবাণুনাশক অটোক্লেভ মেশিন ক্রয়ের উদ্যোগ নিলেও হাসপাতালে দুটি অকেজো মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে জীবাণুমুক্তকরণের ব্যবস্থা না করেই রোগীদের হৃদযন্ত্রের অপারেশন চলছে এবং গত আগস্টের পর ইনফেকশনে রোগী মৃত্যুর হার বেড়েছে। হাসপাতালের দুটি অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে একটি চালু আছে। অপরটিতে পানি পড়ার কারণে অপারেশন কাজ বন্ধ রেখে সংস্কার করা হচ্ছে। পানি পড়ার কারণে ইনফেকশন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ডা. এমআর সিজার স্বীকার করেছেন দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে।এদিকে হাসপাতালে রোগীদের শয্যা পেতে ওয়ার্ডবয়দের ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ারও প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদক বলছে, সিরিয়াল ভেঙে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় ইসিজি করানো এবং ডেথ সার্টিফিকেট নেয়ার সময়ও স্বজনদের কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ নেয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক এমআর সিজার ওয়ার্ডবয় এবং আনসার সদস্যদের দৌরাত্ম্যের কথাও দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। অভিযানে দুদক কর্মকর্তারা দেখতে পান হাসপাতালটিতে বেড প্রাপ্তি, সিরিয়াল ভেঙ্গে ইসিজি ও ইকো করা, ডেথ সার্টিফিকেট নেয়ার সময় বিভিন্ন হারে ঘুষ দিতে হয়। ৪১৪ শয্যার হাসপাতাল হলেও দিনে প্রায় এক হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। ফলে সিট সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ সুযোগে সিট-বাণিজ্য চলছে দেদার। হাসপাতালটির পিসিসিইউয়ে (পোস্ট করোনারি কেয়ার ইউনিট) সিট-বাণিজ্য চলে সবচেয়ে বেশি। সেখানে এক বেড দিনে ৩-৪ বার বিক্রি হয়। হাসপাতালের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পুরুষ রোগী আর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা রোগী থাকেন। ওয়ার্ডগুলো ফ্রি বেডের হওয়া সত্ত্বেও রোগীদের সিট পেতে দিতে হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এ বাণিজ্যের সঙ্গে ১০-১২ জনের একটি চক্র জড়িত। এরা সবাই ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ওয়ার্ড মাস্টার বাহার উদ্দিন। সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন পিসিডিইউর ওয়ার্ড বয় কারী নুরুল ইসলাম ও আশরাফ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয় শামিউল হক ও শামসুল আলম, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয় রেজাউল করিম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের টেবিল বয় শফিউল ইসলাম ও ওয়ার্ড বয় আহসান হাবিব। সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, সিট-বাণিজ্যের সঙ্গে শুধু তারাই জড়িত নন, ওয়ার্ড মাস্টার বাহার এ থেকে মোটা অংকের কমিশন পান।হাসপাতালের নিচ তলার ১৩০ নম্বর কক্ষে ইসিজি, ইকো, ইটিটি, অল্টারের পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত ফি নেয়া হয়। একটি মাত্র কক্ষে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নেয়ার কারণে সেখানে দীর্ঘ লাইন হয়। এই সুযোগে ওইসব বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা অসহায় রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। হাসপাতালটির বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ১০০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। একজন রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রথমেই তাকে ইসিজি ও ইকো করতে দেন চিকিৎসকরা। দিনে ১৫০-২০০ জন পুরুষ রোগীর ইসিজি হয় এবং মহিলা রোগীর ইসিজি হয় শতাধিক। সরকারি ইসিজি ফি ৮০ টাকা। কিন্তু পুরুষ রোগীর ইসিজির দায়িত্বরত টেকনিশিয়ান শহিদুজ্জামান ১০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইসিজি করে দেন। মহিলা ইসিজি রোগীদের দায়িত্বে রয়েছেন জাহানারা শিরিন। তিনিও শহিদুজ্জামানের মতো টাকা নিয়ে বিনা রশিদে ইসিজি করে দেন। পরে তারা রোগীদের কাছ থেকে নেয়া টাকা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। ইকো বিভাগের চিত্র একই। সাদা-কালো ইকো ফি ২০০ টাকা, কালার ইকো ফি ৬০০ টাকা। প্রতিদিন ২০০-২৫০ জন রোগীর ইকো হয়। ইকো কক্ষের কর্মরত ওয়ার্ড বয় সাইফ উদ্দিন প্রতিজনের কাছ থেকে ২০০-৫০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইকো করার ব্যবস্থা করে দেন। দৈনিক এ হাসপাতালে ২০-২৫ জন রোগীর ইটিটি হয়। ইটিটির সরকারি ফি ১০০০ টাকা। ওই বিভাগে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে ৫-৭ জন রোগীর ইটিটির সরকারি ফি জমা দেয়া হয়। বাকী রোগীদের কাছ থেকে ৫০০-৭০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইটিটি করে দেয়া হয়। একই অবস্থা হল্টা মনিটরিং রুমে। সেখানেও দুদকের ভিজিলেন্স টিমের পরিদর্শনে অনিয়ম ধরা পড়েছে। একটি মাত্র কক্ষে টাকা জমা দেয়ার ব্যবস্থা থাকার কারণে রোগীরা নিরুপায় হয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ছোটাছুটি করেন। দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা এর সুযোগ নেয়। বহির্বিভাগ এবং ভর্তিকৃত রোগীদের অধিকাংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে। এখানেও অধিকাংশ সময় রোগীদের রশিদ না দিয়ে টাকা পকেটে নেয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা। এখানে টেকনিশিয়ান আনিসুর রহমান ও রমজান আলী জড়িত। দুর্নীতিবাজ এই দুই কর্মচারীরই রাজধানীর পাইকপাড়ায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে বলে জানা গেছে। হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে বছরের পর বছর কর্মরত আছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দবির উদ্দিন। এখানে মহিলা ও শিশু অপারেশনের রোগী থাকেন। অপারেশনের সময় প্রকারভেদে প্রতিজনের ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। দবির উদ্দিন হাসপাতালের উল্টোদিকে ঢাকা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে রোগীদের বাধ্য করেন। এর কারণ, দবির সেখান থেকে কমিশন পান। এই বিষয়টিও হাসপাতালে ব্যাপক প্রচারিত। হাসপাতালের অনিয়মের আরেক আখড়া হচ্ছে এনজিওক্যাথল্যাব বিভাগ। এমন কোনো অনিয়ম নেই যা এখানে হয় না। হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগীর এনজিওগ্রাম করা হয়। তার মধ্যে ১৫-২০ জন রোগীর রিং পরানো হয়। পেসমেকার স্থাপন করা হয় ৪-৫ জন রোগীর। রোগীর এনজিওগ্রাম এবং রিং পরাবার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় সেটি ডাই নামে পরিচিত। একজন রোগীর ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ডাই প্রয়োজন হয় তার চেয়ে অধিক পরিমাণে রোগীদের দিয়ে কেনানো হয়। পরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডাই নগদ টাকার বিনিময়ে অন্যত্র বিক্রি করে দেয় দুর্নীতিবাজরা। একজন রোগীর জন্য ১০০ মিলি লিটার প্রয়োজন হলে কেনানো হয় কমপক্ষে ৩০০ মিলি লিটার। প্রতি ১০০ মিলি ডাইয়ের মূল্য ১৮০০-২০০০ টাকা। ডাই পাচারের এই সিন্ডিকেটের হোতা ক্যাথল্যাব ইনচার্জ টেকনিশিয়ান তারিকুল ইসলাম লিটন। লিটনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে। রোগীর রিং পরাবার সময় রিং ছাড়াও রোগীকে গাইডার, বেলুন ওয়ার কিনতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে হাসপাতাল সামান্য পরিমাণ সরবরাহ করলেও অধিকাংশই রোগীদের কিনতে হয়। এসব সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করলে জানা যায়, তারিকুল ইসলাম লিটনের কাছে তারা জিম্মি। কোম্পানি তাকে ঘুষ না দিলে রোগীদের ওইসব সামগ্রী ব্যবহারে বাধা দেন তিনি। তার পছন্দের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে রিংসহ অন্যান্য ওষুধপত্র কিনতে রোগীদের তিনি বাধ্য করেন। প্রতি রিং বাবদ তাকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাকে টাকা দেয় না সেই প্রতিষ্ঠানের রিং লাগাতে সে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। লিটনের বিরুদ্ধে আগে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও হাসপাতাল প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা বরং তার দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে। লিটন ওই হাসপাতালে “বড় লোক” কর্মচারী হিসেবে পরিচিত।ক্যাথল্যাবে এনজিওগ্রাম শেষে রোগীকে বেডে পৌঁছতেও হয়রানির শিকার হতে হয়। যারা রোগীকে বেডে পৌঁছে দেন সেই কর্মচারীদের ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বকশিস দেয়াটা বাধ্যতামূলক। রিং পরানো রোগীদের বিকালে শিট খুলতেও ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বকশিস দিতে হয় কর্মচারীদের। ক্যাথল্যাবের ওয়ার্ড বয় আব্দুল গফুর মিয়া ও টেবিল বয় বদিউল আলম টুকু এই সিন্ডিকেটের হোতা।দুদক সূত্র জানায়, হৃদরোগ চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাদের হটলাইন-১০৬-এ প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ আসে। এরপর দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর নির্দেশে চার সদস্যের একটি টিম অভিযান চালায়। অভিযান দলের সমন্বয়ক ও দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, হৃদরোগ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অনুশাসন ভেঙে পড়েছে, এটা ক্ষমার অযোগ্য। এ ব্যর্থতা নিয়ে কারও দায়িত্বে থাকা উচিৎ নয়। দ্রুত এসব অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুদকের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। হৃদরোগ হাসপাতালে এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরাও।