Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

গরু মোটাতাজাকরণ কেমিক্যালে ইউনানি ওষুধ!

প্রিন্ট সংস্করণ॥আব্দুল লতিফ রানা

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৯, ০৬:২১ পিএম


গরু মোটাতাজাকরণ কেমিক্যালে ইউনানি ওষুধ!

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের নামে বিষাক্ত কেমিক্যাল বিক্রি করা হচ্ছে। এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি ওষুধ ব্যবহারে সুস্থ মানুষের কিডনি নষ্টসহ বিকলাঙ্গ ও অন্ধত্বের শিকার হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করেছে। জানা গেছে, অধিকাংশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ গরু মোটাতাজাকরণ কেমিক্যাল দিয়ে বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে। এসব ওষুধ সেবনে সুস্থ মানুষের কিডনিসহ পুরুষত্বও চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারে বলে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কলেজের শিক্ষকরা বলেছেন। তারা বলেছেন, এমন কতগুলো ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে যা, সেবনে শরীরে প্রাথমিক উত্তেজনার আভাস মিললেও পরিণামে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। এ জাতীয় ওষুধ সেবনে বিভিন্ন জটিল ও কঠিন অসুখ হতে পারে বলে পেশাদার ইউনানি চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে। এত কিছু জানার পরও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একটি চিহ্নিত চক্রের সহযোগিতায় ভুয়া ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান ওষুধের নামে প্রাণঘাতী বিষাক্ত দ্রব্য বাজারজাত করে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, মাদকদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কোম্পানির তৈরি ঠাণ্ডা-কাশির সিরাপকে নেশার বস্তু হিসেবে বেছে নেয় মাদকসেবীরা। দেশের বিভিন্ন এলাকার কথিত হারবাল ল্যাবরেটরিতে এসব নেশা ও ভেজাল সিরাপ উৎপাদন করা হচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এ ধরনের ওষুধ বা ভেজাল ইউনানি সিরাপ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করা হচ্ছে। আর এসব কাশির সিরাপ খেয়ে অনেক শিশুসহ বয়স্ক লোকজনও মারা যাচ্ছেন। আর মাদকসেবীরা এখন ডেক্সপোটেন সিরাপ, অফকফ, সুডুকফ, তুসকা, ফেনারগ্যান, ডাইড্রিলসহ বিভিন্ন ঠাণ্ডা-কাশির সিরাপ বেশি খাচ্ছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহুলবাড়িয়া গ্রামে হারবাল ওষুধ পান করে এক শিশুসহ দুইজন মারা গেছেন। এ ঘটনায় আরও একজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। নিহতরা রাজধানীর নবীন হারবাল ল্যাবরেটরি উৎপাদিত সিরাপ খেয়ে মারা গেছেন বলে অভিযোগে জানা গেছে। এ ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা গিয়ে ওই কারখানাটিতে তালা দিয়েছেন। বাড়িটির সিকিউরিটি গার্ড আব্দুস সালাম মৃধা এ তথ্য জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, কতিপয় ভুয়া অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানির বেনামি পার্টনারও রয়েছেন এসব দুর্নীতিবাজ। সরকার ২৫৭টি এলোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানির ওষধ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে যে সব শর্ত ও বিধিমালা আরোপ করেছে, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সেরকম কঠিন কোনো শর্ত আরোপ বা প্রয়োগ করেনি। দেশের ৮২টি হোমিও, ২৬৮টি ইউনানি ও ২০১টি আয়ুর্বেদিক কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে। তারা অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিষাক্ত ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ ওষুধ শাসনের শীর্ষ কর্তারা দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডি, শাহবাগ ও মিটফোর্ডের ওষুধের বাজারে অধিকাংশ ফার্মেসিতে বিক্রি নিষিদ্ধ এসব ওষুধ পাওয়া যায়। এসব ফার্মেসিতে দেশি নিষিদ্ধ ওষুধ ছাড়াও আমদানিনিষিদ্ধ বিদেশি ওষুধও বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গ্রাইপ ওয়াটার অন্যতম। গ্রাইপ ওয়াটার শিশুদের গ্যাসজনিত পেটব্যথায় খাওয়ানো হয়। এ গ্রাইপ ওয়াটারের এক বা দুই চামচ খাওয়ালেই শিশু ঘুমিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, গ্রাইপ ওয়াটারের মধ্যে এলকোহল থাকায় শিশুরা তাৎক্ষণিকভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। পরে ঘুম থেকে জেগে উঠলেও তাদের মধ্যে ঝিমুনি ভাব থেকেই যায়। এ ছাড়া এই ওষুধের প্রভাবে শিশুদের অন্যান্য নানা ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়। হাকিম হাবিবুর রহমান ইউনানি কলেজের একজন শিক্ষক জানান, ওষুধ প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। সরেজমিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দক্ষিণ শেখদির ৪ নম্বর রোডস্থ ১০/১ নম্বর অধ্যক্ষ এরশাদুল্লাহ সড়কের বাড়িতে নবীন ল্যাবরেটরি। চার পাশে নোঙরা পরিবেশ আর মাদকাসক্তদের ভিড় দেখা গেছে। কারখানার মালিক এসকে চৌধুরী ওরফে কাজল চৌধুরী। তিনি এই ভেজাল ও নেশার সিরাপের ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ওই কারখানায় হারবাল সিরাপসহ নেশার ওষুধ তৈরি করে সারাদেশেই সরবরাহ করে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, নবীন ল্যাবরেটরির মালিক চিরতা নামক সিরাপ তৈরি করে বাজারজাত করে অল্প সময়ে কোটিপতি বনে গেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইউনানী চিকিৎসক বলেন, ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল অথাৎ গরু মোটাতাজা করণের কেমিক্যাল দিয়ে চিরতা নামক সিরাপ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছেন। যা খেয়ে মানুষ মোটাতাজা হয়। কিন্তু তার শরীরের কিডনিসহ অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। হাকিম হাবিবুর রহমান ইউনানি মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর হাকিম এ এম মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নবীন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বিষয়টি তদন্ত চলছে। তবে ইউনানির যে ওষুধ খেয়ে কুষ্টিয়ায় একজন শিশু ও বয়স্ক লোকের মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তারা ওষুধ খাওয়ার দীর্ঘদিন পর আবার ওই ওষুধ খেয়ে মারা গেছেন। তাদের পারিবারিক কোনো বিরোধ ছিল কি-না সে বিষয়টি তদন্তের প্রয়োজন। উল্লেখ্য, গত ৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে কুষ্টিয়ার বহুলবাড়িয়া গ্রামের ইটভাটা শ্রমিক নবাব কয়েক মাস আগে স্থানীয় বাজার থেকে একটি হারবাল সিরাপ ক্রয় করেন। ওই সিরাপটি খাওয়ার পর থেকেই শরীরে নানা পার্শ্বপ্রক্রিয়া দেখা দেয়। ঘটনার দিন রাতে নবাব ও তার ৯ বছরের মেয়ে শামীমা হারবাল এ সিরাপটি খায়। তাদের দেখাদেখি পাশের বাড়ির নুর মুহাম্মদ (৫০) সিরাপ পান করেন। এর ২০ মিনিটের মধ্যেই তারা তিন জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মধ্যে বাড়িতেই নুর মুহাম্মদ ও শামীমা মারা যান। আর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নবাবকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।এ ঘটনার পর কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার ওসি আবুল কালাম জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, হারবাল ওষুধ পান করে বিষক্রিয়ায় দুইজন মারা গেছে। আর কেমিক্যাল পরীক্ষার জন্য ল্যাবে স্যাম্পল পাঠানো হয়েছে। আর ওষুধের দোকানদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টর সৈকত কুমার নবীন হারবাল ল্যাবরেটরির সেই সিরাপের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। আর তা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। ল্যাবরেটরির পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে গতকাল যাত্রাবাড়ীর নবীন ল্যাবরেটরি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তাদের কারখানা বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর নির্ভর করছে তাদের কারখানা চলবে কি চলবে না।