Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

নিরাপদ আশ্রয়স্থলই যখন অনিরাপদ, শেষ ভরসা আদালত!

জানুয়ারি ১০, ২০২১, ১২:৫০ পিএম


নিরাপদ আশ্রয়স্থলই যখন অনিরাপদ, শেষ ভরসা আদালত!

তাসমিন মারিয়া (ছদ্মনাম)। দুই বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ায় গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে মায়ের কাছে থেকেই বেড়ে ওঠা তার। তাসমিনের মায়ের অভিযোগ বিচ্ছেদের পরে প্রায় ১৮ বছর দুই মেয়ের খোঁজ রাখেনি বাবা ওমর ফারুক। ঢাকায় বিয়ে করে নতুন সংসারও গড়েন। কিন্তু গত আগষ্ট মাসে তাসমিনের ফুফুর মাধ্যমে যোগাযোগ হয় বাবা ওমর ফারুকের সাথে। দুই বোন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছার কথা জানালে বাবাও তাতে সম্মতি দেন এবং দ্রুত তার বাসায় আসতে বলেন। এক বোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্দানে ইউনিভার্সিটিতে এলএলবি ও আরকেজন ইংরেজিতে ভর্তিও হোন। এবং তেজগাঁও পূর্ব রাজার বাজার সকিনা মসজিদের পাশে বাবার বাসায়ই ওঠেন। বিপত্তি ঘটে এখানেই। কে জানতো নিজ মেয়ের প্রতি বাবার যৌন লালসার কথা। বাবা ওমর ফারুকের প্রতিনিয়ত যৌন নিগ্রহ ও অনৈতিক প্রস্তাবে তার বাসায় ওঠা কাল হয়ে ওঠে দুই বোনের জন্য।

তাসমিনের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় বাবা ওমর ফারুক তাদের যৌন উত্তেজক কথা বলে। তাকে একান্ত সময় দিতে বলে। এমনকি মাঝেমধ্যে আপত্তিকরভাবে শরীরেও হাত দেন। প্রতিবাদ করলে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়ারও হুমকি দেন।

স্বজনদের কাছে বাবার যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করে কোন প্রতিকার না পাওয়ায় পরে আদালতের দারস্থ হোন দুই বোন। বাবা ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আদালতে মামলা ঠুকে দেন তাসমিন মারিয়া। মামলা নং ১৫১২/২০। মামলাটি ঢাকার ৬ নং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আশেক ইমামের আদালতে বিচারাধীন।

গত ১৫ ডিসেম্বর ও ২৯ ডিসেম্বর দুই দফা ভুক্তভোগীদের কেনো সুরক্ষা দেয়া হবে না এই মর্মে কারণ দশানোর নোটিশ দেয়া হলেও বিবাদী এর কোন জবাব দেননি। পরে আদালত আগামী ১৪ জানুয়ারি আবারো দিন ধার্য করেছেন।

এমন অবস্থায় বিশ্লেষকেরা বলছেন, আসামিকে দুই দফা কারণ দশানোর নোটিশ দেয়া অযৌক্তিক। প্রথমবার নোটিশের জবাব না দেয়ার পরেই পরোয়ানা জারি করা উচিত ছিলো। আদালতের উচিত ছিলো আগে মেয়ে দুটোকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটা অন্তবর্তিকালীন আদেশ দেয়া। কিন্তু সেটা না করে অভিযুক্ত পিতাকে বারবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে এতে তাদের জীবন সংশয়ের মধ্যে পড়তে পারে।

কারণ, নোটিশ পেয়ে তাদের পিতা ক্ষিপ্ত ও প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুও ঘটাতে পারে। এবং এতে তারা আত্মহননের পথেও হাঁটতে পারে। আর যেখানে বাবার কাছে সন্তানের নিরাপদ থাকার কথা অথচ সেখানেই নিরাপত্তা না পাওয়া সমাজে বিরুপ প্রভাব ফেলবে বলেও দাবি বিশ্লেষকদের।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান আমার সংবাদকে বলেন, বাবার হাতে মেয়ে যৌন নিগ্রহের শিকার হলে এটা পারিবারিক সহিংসতা ও সুরক্ষা আইনে মামলা করা উচিত হয়নি। এটা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলা অন্য আইনে এর তেমন কোনো প্রতিকার মিলবে না। সুরক্ষা আইনে যৌন নির্যাতনের কোনো বিষয় উল্লেখ নাই এজন্য এ ধরনের মামলা এই আইনে যাবে না। যেহেতু অভিযুক্ত ধর্ষণের চেষ্টা বা ইচ্ছার বিষয়টি প্রকাশ করেছে তাই মামলাটি নারী শিশু নির্যাতন আইনের ৯ এর ৩ ধারায় করতে হবে। ক্যান্সারের ঔষুধ প্যারাসিটামল দিলে হবে না। আর সুরক্ষা আইনে বিচারক চাইলেও এর কোন প্রতিকার দিতে পারবেনা। পারিবারিক সুরক্ষা আইন জজ সাহেবের বিচারিক ক্ষমতাকেও একটা সীমারেখার মধ্যে রাখা হয়েছে। তাই চাইলেই সে কোন আদেশ দিতে পারবে না। আইনের ধাপে ধাপে তাকে আগাতে হবে এজন্যই বার বার কারন দশানের নোটিশ দেয়া হচ্ছে। আর নারী শিশু নির্যাতন আইনে মামলাটি হলে সরাসরি গ্রেফতারের আদেশ দেয়া হতো। 

এ বিষয়ে মামলার বাদী তাসমিন মারিয়া আমার সংবাদকে বলেন, আমি ভার্সিটির টিউশন ফির জন্য বাবার কাছে গত ২৩-১১-২০২০ তারিখে টাকা চাইলে বাবা বলেন, ‘আমি যে তোমাকে এতোগুলো টাকা দিবো তাতে আমার কি লাভ? তোমরা দুই বোন আমার কাছে আসো আমি সব দিবো।’ পরে আমি বলি আমরাতো আপনার বাসায়ই আছি, আর কত কাছে আসবো? তখন বাবা আমাকে তার সাথে একই বিছানায় থাকার প্রস্তাব দেন। এবং তিনি বলেন, ‌‘আমার সাথে ফ্রি হও,আমি যা করতে বলি তাই করো, তোমার কোন অভাব রাখবো না। আমার কাছে রাতে থাকবা আমি যা বলি তাই করবা। আমিও তোমাদের কোন কাজে বাধা দেবো না। তোমাদের নামে ফ্লাট লিখে দিবো’। আমি বাবার এসব জঘন্য কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করলে বাবা বলেন, ‘আমার বিছানায় না আসলে সময় না দিলে আমি তোদের কিছুই দিবো না, কোন খরচও দিতে পারবো না।’

তাসমিন মারিয়ার আরেক বোন তানভিন ফারিয়া আমার সংবাদকে বলেন, আমার বোনকে এতো কিছু বলার পরেও আমি নিরুপায় হয়ে বাবার কাছে টাকা চাইতে গেলে বাবা আমাকেও আপত্তিকর জঘন্য ভাষায় কথা বলেন। বাবা আমাকে বলেন, তার কোন লাভ না থাকলে তিনি কোন টাকা দিতে পারবেন না। টাকা নিতে হলে তাকে খুশি করতে হবে। আব্বু বলেন, ‘‘তোর মায়ের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই, তার মানে তোরা আমার ব্যবহারের জন্য বৈধ। তোরা আমাকে আব্বু বলে ডাকিস, কিন্তু আব্বার ‘ব’ ফেলে দিলে আর আব্বু থাকে না তখন স্বামী হয়ে যায়। যদি আমাকে প্রিয় মানুষ ভেবে রাতে আমার বিছানায় আসতে পারিস তাহলে সব পাবি। আর আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করলে দুটোকে মেরে ফেলবো।’’

মেয়েদের করা অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য আসামি ওমর ফারুকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মেসেজ পাঠিয়েও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। 

মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এই মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইমরুল হাসান আমার সংবাদকে বলেন, আসলে অধিকাংশ আদালতই পারিবারিক সহিংসতা ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ সম্পর্কে অবগত নয়। এ ধরনের মামলা নিয়ে গেলে তারা অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি আদেশ দেয়ার ক্ষেত্রেও সময়ক্ষেপন করেন। মাঝেমধ্যে এমনও হয় বিচারক বলেন এ আইন সম্পর্কে তার তেমন কিছু জানা নেই নথি পড়ে পরে আদেশ দিবেন। এটা খুবই হতাশাজনক। তাই আমার অভিমত আইন মন্ত্রণালয়ের উচিত বিচারকদের এসব মামলার যথোপযুক্ত বিচার করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা। নচেৎ ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হবে। আর আমার মামলার বাদীর এমন খারাপ সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানের মত কেউ নেই। বাবার দ্বারা মেয়ের যৌন হেনস্থা খুবই দুঃখজনক। নিরাপদ আশ্রয়স্থল যখন অনিরাপদ হয়ে যায় তখন সমাজে এটা খারাপ বার্তা বয়ে আনে।

মামলার অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, মামলাটি ঢাকার ৬ নং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এমএম) আদালতে বিচারাধীন। গত ১৫ ডিসেম্বর  বিচারক আশেক ইমাম দুই বোনকে কেনো সুরক্ষা দেয়া হবেনা এর কারণ দর্শাতে পিতা ওমর ফারুককে নির্দেশ দেন। তবে আসামি এর কোন জবাব আদালতে দাখিল করেনি। তাই গত ২৯ ডিসেম্বর আবারো কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে আগামী ১৪ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন। আদালত চাইলে একটা আদেশ দিতে পারতেন। শুনানির দিনও আমরা আদালতে দুই বোনের যৌন হেনস্থা বন্ধ ও বেতন সহ বাড়ি ভাড়া প্রদানের জন্য একটা অন্তরবর্তিকালিন আদেশ চেয়েছিলাম কিন্তু সেই দরখাস্ত আদালত নথিভুক্ত করেও কোন আদেশ দেয়নি। 

আদালত থেকে দুই দফা কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া কতটা যৌক্তিক এবং এতে তাদের জীবন সংশয়ের মধ্যে পড়তে পারে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার মিতি সানজানা আমার সংবাদকে বলেন, আসলে আদালত কোন গ্রাউন্ড বিবেচনায় দুই দফা নোটিশ দিয়েছে সেটা আদালতই ভাল বলতে পারবে। এটা নিয়ে আইনজীবী হিসাবে আমরা মন্তব্য করতে পারি না। মূলত আইন অনুসারে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আছে। যেমন চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির সুযোগ। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ। আর আবেদনপ্রাপ্তির পর আদালত যদি আবেদনপত্রের সঙ্গে উপস্থাপিত তথ্য পর্যালোচনা করে সন্তুষ্ট হন যে প্রতিপক্ষ কর্তৃক পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে বা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তবে আদালত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অন্তবর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন।

বাবার দ্বারা মেয়ের যৌন নির্যাতনের ঘটনা সমাজে কেমন প্রভাব ফেলবে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সমাজে একটা খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আর পরিবারের এক সদস্য দ্বারা অন্য সদস্য সহিংসতার শিকার অহরহ ঘটে। তবে অনেকসময় এসব বিষয়গুলো অপ্রকাশিত থেকে যায় ফলে এর কোন প্রতিকার মেলে না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী এসব অনাচার নিরবে সহ্য করে বা করছে। তাই যেহেতু বাবার যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে সাহস করে মেয়ে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছে এবং প্রতিবাদ করছে সেজন্য আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই। আর নিরবে সহ্য না করে এসব অত্যাচারের বিষয়গুলো মিডিয়ায় আসা উচিত ও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, আসামি ওমর ফারুক তেজগাঁও সাব-রেজিস্টার অফিসের দলিল লেখক হিসাবে কর্মরত আছেন। তাসমিন ও তানভিনের বয়স যখন ২ বছর তখন তাদের মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের পর তাসমিনের বাবা ঢাকায় একাধিক বিবাহ করে। তখন থেকেই তাদের দুই বোনের কোন প্রকার খোঁজ খবরও রাখেনি ভরণপোষণ দেননি তার বাবা। মাঝেমধ্যে ফোনে খরচের টাকা চাইলে তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করা হতো। বিচ্ছেদের পর তাসমিনার মা খুব কষ্টে ধার দেনা করে ও ভাই বোনদের সহায়তা নিয়ে তাদের দুই বোনকে লেখাপড়া করায়। বিগত ২০১৯ সালে তাসভিন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর তার মা স্বপ্ন পূরনের আসায় পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করিয়া নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি তে ভর্তি করায়। লেখাপড়ার খরচ জোগাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে দুই বোন তার বাবা ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করলে ওমর ফারুক পড়াশোনার সকল খরচ দিবে বলে তার উল্লেখিত ঠিকানার বাসায় আসতে বলে। পরে দুই বোন গত আগস্ট মাস থেকে তার বাবার বাসায় বসবাস শুরু করেন। বাসায় আসার পর থেকেই ওমর ফারুক দুই বোনকে বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব দিতে থাকে এবং বাসার মধ্যে তানভিনের সামনে বসে লাউড স্পীকারে পর্নো ভিডিও ছেড়ে দেন এবং তাদেরকে নিষিদ্ধ কাজে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। পিতা ওমর ফারুককে এসব করতে নিষেধ করায় ওমর ফারুক বলে তোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস আর এসব বুঝিস না। পরে দুই বোন বাধ্য হয়ে এসব ঘটনা তার ফুফুদের জানালে ফুফুরা ও কোন ব্যবস্থা নেননি। পরে জীবন বাঁচাতে দুই বোন আবারো ভাড়া বাসায় ওঠেন। দুই বোনের সাথে বাবার করা যৌন অত্যাচারে তারা মানসিক যন্ত্রনায় ভুগে মারাত্বকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছোটবোন বাবার মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা চেষ্টা করে পরে বড় বোনের বাধায় বেঁচে যান। 

আমারসংবাদ/এসআর/জেআই