Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

ম্যারাডোনা যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বাংলাদেশের ভক্তদের

স্পোর্টস ডেস্ক

নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০৩:৫৫ পিএম


ম্যারাডোনা যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বাংলাদেশের ভক্তদের

বাংলাদেশে আশির আর নব্বইয়ের দশকে মধ্যম আর স্বল্প আয়ের মানুষদের টেলিভিশন সেট কেনার একটি বড় উপলক্ষ ছিল বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা। আর ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা।

সেই সময় ঢাকার বাসিন্দা মেহেদি আনসারি ছিলেন স্কুল ছাত্র। অথচ স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট হয়ে আছে ম্যারাডোনার খেলা টেলিভিশনে সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা।

আনসারি বলেন, সে সময় উপগ্রহ থেকে সরাসরি খেলা দেখা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। ফাইনালের সময় আমরা আশেপাশের লোকজন মিলে খেলা দেখতাম। ওই সময় ম্যারাডোনার পারফর্মেন্স, টানটান উত্তেজনা সেটার কোন তুলনা নাই। ম্যারাডোনা আমাদের জন্য একটা ব্র্যান্ড, একটা অনবদ্য চরিত্র। তিনি যেখানেই গিয়েছেন যাই করেছেন, আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন।

তার মতে বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা এবং আর্জেন্টিনার বিশাল ভক্তকুল গড়ে উঠেছিল এই বিরল প্রতিভার অসাধারণ পারদর্শিতা দেখেই।

ফুটবল বিশ্বে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথ অনেক পুরনো হলেও, ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে, পাড়া-মহল্লায় যে ফুটবল বন্দনা এবং আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দল নিয়ে উত্তেজনা সেটার বীজ বুনেছিলেন এই জাদুকরী ফুটবলার।

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল মেক্সিকো বিশ্বকাপ। সেবার ম্যারাডোনার অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জয় করে নেয় আর্জেন্টিনা।

আর নিজ দেশ থেকে হাজার-হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে তৈরি হয় তার অগণিত ভক্ত।

ম্যারাডোনার খেলাগুলো টেলিভিশনে সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ডালিয়া আক্তারও।

বাংলাদেশের আরো অনেক পেশাদার ফুটবলারের মত ডালিয়া আক্তারও প্রিয় খেলোয়াড়ের সেই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখে ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার অনুপ্রেরণা পান।

তিনি বলেন, ছোটবেলায় ম্যারাডোনার খেলা দেখেই আমার ফুটবল প্রীতি জেগেছে। উনি আমার আইডল। একটা হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ ম্যারাডোনা তার একার পারদর্শিতায় জিতিয়ে দিতে পারতেন। তার ক্রীড়াশৈলি আমার মতো অনেক ফুটবলারকেই উদ্বুদ্ধ করেছে।

তার মতে খর্বকায় এই খেলোয়াড় দারুণভাবে একাধিক প্রতিপক্ষকে অসাধারণ নৈপুণ্যতায় কাটিয়ে জালে বল জড়িয়ে ফুটবল দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।

বল পায়ে তার গতি ও দক্ষতা বাংলাদেশের ফুটবলার এবং ভক্তদের বারবার মন্ত্রমুগ্ধ করেছে।

ডালিয়া আক্তারের ফুটবলের প্রতি গভীর ভালবাসা এসেছে সেই ম্যারাডোনা থেকেই।

তিনি বলেন, অনেক খেলোয়াড় ড্রিবলিং ভালো করলেও শেষমেশ স্কোরটা করতে পারেন না। কিন্তু ম্যারাডোনা ড্রিবলিং থেকে শুরু করে গোল করা পর্যন্ত ফিনিশিং পুরো বিষয়টাতে পারদর্শী ছিলেন। এটা সব খেলোয়াড়ের থাকে না। সেজন্যই তিনি বাংলাদেশিদের কাছে এতো অনন্য ছিলেন।

সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক দিলু খন্দকারের সুযোগ হয়েছিল ১৯৯৪ সালে আমেরিকার বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার খেলা মাঠে বসে দেখার, তার সাথে সরাসরি কথা বলার।

সে বছর বিশ্বকাপের মাঝ পথেই ডোপিংয়ের অভিযোগে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। সে সময় কেঁদে চোখ ভাসিয়েছিল বাংলাদেশের কোটি ভক্ত।

ফিফার এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছিল বাংলাদেশে। মামলা হয়েছিল বাংলাদেশের আদালতে।

বিশ্ব মিডিয়ায় জায়গা পেয়েছিল বাংলাদেশের এই ফুটবল উন্মাদনার খবর।

দিলু খন্দকার জানান, আশির দশকের আগে বাংলাদেশে ব্রাজিলের সমর্থক বেশি থাকলেও ম্যারাডোনা মাঠে নামার পর থেকেই চিত্র বদলে যায়।

বাংলাদেশের মানুষের মনে শুধু আর্জেন্টিনার প্রতি নয় বরং ফুটবল প্রেম জাগিয়ে তুলেছেন ম্যারাডোনা।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে ফুটবল প্রীতি, আর্জেন্টিনা প্রীতি সেটা ম্যারাডোনার জন্য। তিনি এমন অসাধারণ ফুটবল খেলেছেন যে মানুষকে জাদুর মতো নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন।

তার মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর্জেন্টিনা দীর্ঘসময় কোন সাফল্য না দেখলেও ম্যারাডোনাকে ঘিরে যে উন্মাদনা হয়েছিল, সেটা এখনও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রবাহিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ভক্তদের কাছে ম্যারাডোনা ফুটবলের ঈশ্বর আখ্যা পেয়েছিলেন। এই মহানায়কের প্রস্থানে শোকে ভাসছে বাংলাদেশের প্রতিটি বয়স ও শ্রেণী পেশার অগণিত মানুষ।

২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হয় স্পেশাল অলিম্পিক। এ উপলক্ষে ২০১৮ সালে ৩০টি দেশ নিয়ে এক মিনি ফুটবল আসরের আয়োজন করা হয়। সেখানে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল বাংলাদেশ দল। 

সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করা বাংলাদেশ ইউনিফাইড ফুটবল দলের সঙ্গে একটি ছবি ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন ম্যারাডোনা। তখন তিনি ছিলেন আবুধাবির আল ফুজাইরা ক্লাবের কোচ। সেসময় ফুজাইরা ক্লাবের মাঠেই অনুশীলন করেছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। বাংলাদেশি ফুটবলারদের সঙ্গে দশ মিনিটের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলে ছিলেন অনেক ছবিও।

ছবি পোস্ট করে ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বন্ধুদের সঙ্গে। যারা ২০১৯ সালে আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত স্পেশাল অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করবেন। তাদের আল ফুজাইরা ক্লাবে আমাদের সঙ্গে অনুশীলনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। খেলাধুলা একটি বিস্ময়কর বিষয়। কারণ সবকিছু অতিক্রম করে এটি আমাদের আরও কাছাকাছি এবং একসঙ্গে নিয়ে আসে। সবার জন্য চুম্বন। বিশেষ করে যারা প্রতিদিন তাদের নিজেদের সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করেন।

ম্যারাডোনাকে কাছে পাওয়ার সে স্মৃতি এখনো মলিন ইউনিফাইড দলের কোচ আবদুর রাজ্জাকের কাছে। সে মুহূর্তটি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। আমাদের সঙ্গে প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মতো ছিলেন। তিনি এলেন আর আমাদের জয় করে চলে গেলেন।
যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘তোমরা চ্যাম্পিয়ন হলে আমি খুশি হব।’ আরব আমিরাতকে হারিয়ে আমরা চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম।

কোচ রাজ্জাক ম্যারাডোনাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন, ‘তুমি কি বাংলাদেশে আসবে?’ জবাবে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘শুনেছি বাংলাদেশে অনেক আর্জেন্টিনার সমর্থক আছে। আমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই যাব।’

আমারসংবাদ/জেআই