Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

থামছেনা ফুটবল বিশ্বের কান্না

নভেম্বর ২৭, ২০২০, ১২:৩৫ পিএম


থামছেনা ফুটবল বিশ্বের কান্না

আর্জেন্টিনা কাঁদছে। সেইসাথে কাঁদছে পুরো ফুটবল বিশ্ব। কান্না যেন থামছেইনা ম্যারাডোনার ভক্তদের। কিভাবেই বা থামাবে কান্না? ফুটবল ইশ্বরকে হারিয়ে শুণ্যতার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন।

গত বৃহস্পতিবার সকালে আর্জেন্টিনাবাসীর ঘুম ভেঙেছে বিষণ্নতার চাদর সরিয়ে। সেই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে বেদনার চর। বুয়েনস আয়ার্সে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস কাসা রোসাদায় কফিনে শুয়ে আছেন কিংবদন্তি ফুটবলার। অশ্রুর প্লাবনে তাকে শেষবার দেখতে ভিড় জমিয়েছিলো হাজার হাজার মানুষ। অনেকের গায়ে বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনার ১০ নম্বর জার্সি। আর্জেন্টিনার সাদা-নীল জাতীয় পতাকা ও তার ১০ নম্বর জার্সিতে ঢাকা কফিন। জনতার ঢল নামার আগে প্রভাতে ম্যারাডোনার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এসে তাকে দেখে গেছেন শেষবারের মতো। শেষ দেখাটা দেখার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি তাদের। আগের রাতে প্লাজা ডি মায়োতে হাজার হাজার ভক্ত গান গেয়ে শ্রদ্ধা জানায় ম্যারাডোনাকে।

ফুলে ফুলে, ভালোবাসায় ৮৬ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকরকে স্মরণ করে ভক্তরা। তাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের উপকণ্ঠে ফুটবলের বংশীবাদক ম্যারাডোনার শেষকৃত্য হয়। জার্দিন দে পাজ গোরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে সমাধিস্থ করা হয় চিরকাল শিশু থেকে যাওয়া আর্জেন্টাইন ফুটবল লিজেন্ডকে।

ম্যারাডোনার প্রয়াণে বিশ্বময় ফুটবলানুরাগীদের দুচোখে প্লাবন। কে যেন বলেছেন, ম্যারাডোনা নামটার মধ্যে একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেছিলেন, ‘দিয়েগোর সবচেয়ে বড় শত্রু ওর আবেগ।’ তাকে ঘিরে যাদের মুগ্ধতা ছিল আদি ও অকৃত্রিম, তারাও অন্তবিহীন আবেগে ভেসে গেছেন খড়কুটোর মতো। সেই আবেগের আবরণ অতিঅবশ্যই ফুটবলময়। শিশুর সারল্য আর বুকভরা আবেগে ঋদ্ধ মানুষটি ছিলেন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর গুণমুগ্ধ ভক্ত। কাকতালীয়ভাবে কাস্ত্রোর প্রয়াণ দিবসে ম্যারাডোনাও যাত্রা করলেন অনন্তলোকে।

তিনি বিশ্বজয়ী ফুটবলার। বল পায়ে নান্দনিকতার ঝংকারে কয়েকটি প্রজন্মকে মোহিত করে রাখা জাদুকর। আর্জেন্টাইনদের চোখের মণি। নেপলসের রাজা। ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের একজন। ইতিহাস রাঙানো অসংখ্য অর্জন, কীর্তি। প্রতিভা, উন্মাদনা, মাদক, বিতর্ক, দ্রোহ, রোমাঞ্চ আর আবেগ মিলিয়ে দিয়েগো ম্যারাডোনা একজনই। তার মতো কেউ ছিল না, হয়তো কেউ আসবেও না।

বিশ্ব ফুটবল ও ক্রীড়াঙ্গন ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জীবনের চেয়েও বড় এক চরিত্র। গোটা দুনিয়াকে ফুটবলের উথাল প্রেমে মাতানো। সেই মানুষ সবাইকে কাঁদিয়ে আচমকা চলে গেলেন গত বুধবার। ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই কাঁদছে আর্জেন্টিনা, কাঁদছে গোটা ফুটবলবিশ্ব। রাজনীতি ও বিনোদন জগতও শোকে আচ্ছন্ন। 

[media type="image" fid="99055" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

ইমরান খান থেকে নরেন্দ্র মোদি, শাহরুখ খান থেকে টম ক্রুজ- ম্যারাডোনার মহাপ্রয়াণ ছুঁয়ে গেছে সবাইকে। পেলে, মেসি, রোনালদোদের মতোই শোকের সাগরে ভাসছেন উসাইন বোল্ট, রাফায়েল নাদাল, শচীন টেন্ডুলকাররা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে অন্যলোকে ফুটবল খেলতে চাওয়ার আকুতি করেছে ফুটবল সম্রাট পেলের কণ্ঠে। ম্যারাডোনা নেই, এই অমোঘ সত্যটা বিশ্বাস হচ্ছে না রোনালদিনহোর। শোকার্ত মেসি এই ভেবে সান্ত্বনা খুঁজছেন যে, চিরন্তন ম্যারাডোনার মৃত্যু নেই।

সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন ম্যারাডোনার সহযোদ্ধারা। এক লাইভ অনুষ্ঠানে ‘দিয়েগোর সঙ্গে আমার কত স্মৃতি, কত খুশির মুহূর্ত’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ম্যারাডোনার বিশ্বজয়ের সারথী হোর্হে ভালদানো, ‘আর্জেন্টিনার সবাই তার জন্য কাঁদছে। যারা ফুটবল ভালোবাসে, তারা তো কাঁদছেই। এমনকি তার বিদায়ে ফুটবলও কাঁদছে।’ ফুটবল রাজপুত্রের আরেক সাবেক সতীর্থ ও আতলেতিকো মাদ্রিদের কোচ দিয়েগো সিমিওনে বলেছেন, ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্বের প্রতিটি ফুটবল মাঠে তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি সর্বকালের সেরা ছিলেন, থাকবেন।’ মাদ্রিদের আরেক বিখ্যাত ক্লাব রিয়ালের কোচ ফরাসি কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান বলেছেন সবার মনের কথাটা, ‘৮৬ বিশ্বকাপ আমাদের প্রজন্মের মাথায় গেঁথে আছে। দিয়েগো আমাদের সবার মহানায়ক। আমার কিছু বলার ভাষা নেই। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।’ ম্যারাডোনার খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি যাদের, সেই তরুণ প্রজন্মের সেরা ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পেও মুষড়ে পড়েছেন, ‘শান্তিতে থাকুন কিংবদন্তি। ফুটবল ইতিহাসে আজীবন থাকবেন আপনি। সারা বিশ্বকে অপার আনন্দ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।’ 

ম্যারাডোনার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গত বুধবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সব ম্যাচের আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নিজ দলের ম্যাচ শেষে মার্শেই কোচ আন্দ্রে ভিয়াস-বোয়াস আহ্বান জানালেন, ‘ফিফাকে আমি অনুরোধ করব ১০ নম্বর জার্সি স্থায়ীভাবে তুলে রাখা হোক। এটাই হতে পারে দিয়েগোর প্রতি সম্মান জানানোর সবচেয়ে ভালো উপায়।’ একইভাবে নেপলসের মেয়র ম্যারাডোনার নামে নাপোলির স্টেডিয়ামের নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন। নাপোলি অধিনায়ক লরেন্সো ইনসিনিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন ক্লাবের যুগস ষ্টাকে, ‘আপনি আমাদের দিয়েগো। ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। একজন ভক্ত, একজন নাপোলিতান ও একজন ফুটবলার হিসেবে বলছি, সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ মহানায়ক। সব সময় আপনাকে ভালোবাসব।’

ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো এক শোকবার্তায় বলেছেন, ‘তার সুন্দর খেলা দেখেই আমরা সবাই ফুটবলের প্রেমে পড়েছি। খেলাটির জন্য ম্যারাডোনা যা করেছেন তা অনন্য। তার মৃত্যু নেই।’

এক বছর আগে আর্জেন্টিনায় দেখা একটি ব্যানারের কথা মনে পড়ছে ম্যানসিটি কোচ পেপ গার্দিওলার, ‘‘ব্যানারে লেখা ছিল, ‘তোমার জীবনে তুমি কী করেছ তা কোনো ব্যাপার নয় দিয়েগো, গুরুত্বপূর্ণ হল তুমি আমাদের জন্য যা করেছ।’ ম্যারাডোনা আমাদের যা দিয়েছেন তা নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে এ লেখায়।’’ 

ফরাসি কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনির মনে পড়ে যাচ্ছে আশির দশকের সেই সোনালি দিনগুলো, ‘কী একটা সময়ই না আমরা কাটিয়েছি। সোনালি অতীতের সেরা অংশটাই যেন হারিয়ে ফেললাম।’ ব্রাজিলীয় গ্রেট রোনালদোর শ্রদ্ধার্ঘ্য, ‘আমাদের খেলাটি তার অন্যতম সেরা দূতকে হারিয়েছে। আমি হারিয়েছি আমার শৈশবের প্রেরণা ও প্রিয় বন্ধুকে। দিয়েগোর এমন বিদায়ে আমি স্তব্ধ। মাঠে আপনার জাদু চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শান্তিতে ঘুমান কিংবদন্তি।’

আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করছে ফিফা। এ উপলক্ষে ‘হোম অব ফিফা’য় পতাকা অর্ধনমিত রেখেছে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় প্রাধান্য পেয়েছে দিয়েগো মারাদোনার মৃত্যুর খবর। শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে ‘ফুটবল ঈশ্বরকে’। ফ্রান্সের বিখ্যাত ক্রীড়া দৈনিক ‘লেকিপে’ মারাদোনার জাতীয় দলের আকাশি-সাদা জার্সি পরা একটি ছবি দেওয়ার পাশাপাশি শিরোনাম করেছে, ‘ঈশ্বর এখন মৃত।’

ট্রফি উঁচিয়ে ধরা ছবি দিয়ে আর্জেন্টাইন পত্রিকা ক্লারিন লিখেছে, ‘সমতুল্য কেউ হবে না।’ স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মুন্দো দেপোর্তিভো মারাদোনার বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সিসহ শুধু লিখেছে ‘এডি১০এস।’ ৬০ বছর বয়সে ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে বিতর্ক কখনোই তার পিছু ছাড়েনি।

[media type="image" fid="99054" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

সদ্য প্রয়াত এই কিংবদন্তির বিখ্যাত ১১টি উক্তিঃ

১. ‘বল দেখা, এর পেছনে ছোটার মাধ্যমে আমি হয়ে উঠি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।’

২. ‘আমি ভুল করেছি এবং সেগুলোর জন্য মাশুলও গুণেছি। কিন্তু বল এখনও খাঁটি।’

৩. ‘আমি ম্যারাডোনা। যে গোল করে, ভুলও করে। আমি এগুলো সবই বয়ে বেড়াতে পারি। সবার সঙ্গে লড়াই করার মতো বিশাল এক কাঁধ রয়েছে আমার।’

৪. ‘আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমি ঝুঁকি নেই না, এ কথা কখনও বলতে পারবেন না।’

৫. ‘আমি কালো কিংবা সাদা হতে পারি কিন্তু জীবনে কখনও ধূসর হব না।’

৬. ‘আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সবকিছুই ঘৃণা করি। আমি এগুলোকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘৃণা করি।’

৭. ‘পেলে এবং আমার মধ্যে কে সেরা তা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকবে না। সবাই আমার কথাই বলবে।’

৮. ‘পেলের উচিত যাদুঘরে চলে যাওয়া।’

৯. ‘গোলটি দেয়ার পর আমি চাইছিলাম সতীর্থরা আমাকে জড়িয়ে ধরুক কিন্তু কেউ আসছিল না...আমি তাদের বললাম, এসো আমাকে জড়িয়ে ধর। নাহলে রেফারি এটা বাতিল করে দেবে।’

১০. ‘ক্ষমা চেয়ে ইতিহাস পাল্টে দিতে পারলে আমি অবশ্যই তা করতাম। কিন্তু গোলটি এখনও একটি গোলই। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হল এবং আমি হয়ে গেলাম বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়।’ 

১১. ‘গোল করার পরে মেসি স্বাভাবিক উদযাপন করে। আর ক্রিশ্চিয়ানো গোল করে এমন ভাব করে যেন সে শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন শ্যুটিং করছে।’

আমারসংবাদ/জেআই