“ঐতিহ্য যেখানে জ্ঞানচর্চার উৎস”—এই স্লোগান যেন বাস্তব রূপ পেয়েছে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার ঐতিহাসিক চৌধুরী জমিদার বাড়িকে ঘিরে। এক সময়ের রাজকীয় গৌরবের প্রতীক এই জমিদার বাড়ি এখন শুধু ইতিহাস নয়, বরং তা রূপ নিয়েছে আধুনিক শিক্ষার এক প্রাণবন্ত কেন্দ্রে—নাগরপুর মহিলা অনার্স কলেজ।
চৌধুরী বংশের জমিদারির সূচনা হয় সুবিদ্ধা খাঁর বংশধর যদুনাথ চৌধুরীর মাধ্যমে, যিনি প্রায় ৫৪ একর জমির ওপর এই জমিদারির ভিত্তি স্থাপন করেন। তার পুত্র উপেন্দ্র মোহন, জগদীন্দ্র মোহন ও শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী জমিদারির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উপেন্দ্র মোহনের বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরী সমাজসেবার জন্য “রায় বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত হন। তার ছোট ছেলে সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন আধুনিক চিন্তাধারার ক্রীড়াবিদ এবং ঐতিহাসিক ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি।
জমিদার বাড়ির ‘বৈঠকখানা’ ভবনটি মোঘল ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যশৈলীর অনন্য সংমিশ্রণ ছিল। তার ওপর ছিল নহবতখানা, যেখানে প্রতিদিন ভোরে সানাইয়ের সুরে ঘুম ভাঙত এলাকাবাসীর। পাশেই ছিল রঙ্গমহল এবং পারিবারিক চিড়িয়াখানা, যেখানে ময়ূর, কাকাতোয়া, হরিণ, ময়না এমনকি পরবর্তীতে বাঘ ও সিংহও রাখা হয় সুরেশ চৌধুরীর ইচ্ছায়।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সরকার জমিদারির সমস্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে। সেই ইতিহাসবাহী ভবনেই গড়ে ওঠে আজকের নাগরপুর মহিলা অনার্স কলেজ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূর মোহাম্মদ খান ১৯৮৯ সালের ২৬ আগস্ট “রওশন এরশাদ মহিলা বিদ্যালয়” নামে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন। নব্বই দশকে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “নাগরপুর মহিলা অনার্স কলেজ”। বর্তমানে কলেজে প্রায় ১,৪৭০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।
কলেজের কেচি গেটের পাশে এখনও দৃশ্যমান জমিদার আমলের চারটি পুরোনো তালা, যা সেই সময়ের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। সম্প্রতি সরকারি সহায়তায় মূল ভবনের সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। মেরামত করা হয়েছে ভগ্নপ্রায় দেয়াল, ছাদ, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুম এবং আধুনিক করা হয়েছে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ক্যাম্পাসজুড়ে সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে কলেজ চত্বরকে করা হয়েছে আরও দৃষ্টিনন্দন।
ফলে বর্তমানে নানা জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা প্রতিদিনই ছুটে আসছেন—কেউ ইতিহাস জানতে, কেউবা প্রাচীন স্থাপত্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
স্থানীয়রা বলছেন, “এই জমিদার বাড়িটি সরকারিভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে তা নাগরপুরবাসী ও শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে।”
কলেজের অধ্যক্ষ মো. আনিসুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, “এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় জমিদারদের ২২ একর জমির মধ্যে ৫.৮১ একর কলেজের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে দুঃখজনকভাবে কিছু জমি এখনও বে-দখলে রয়েছে।”
ইতিহাস, স্থাপত্য, ঐতিহ্য ও শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয়—নাগরপুরের এই জমিদার বাড়িটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সরকারিভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারলে এটি দেশের অন্যতম শিক্ষনীয় ও দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতে পারে।
ইএইচ