আদালতপাড়ায় দালালের দৌরাত্ম্য

শরিফ রুবেল প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০২২, ০২:২৮ এএম
আদালতপাড়ায় দালালের দৌরাত্ম্য

গায়ে কালো কোট-গাউন আছে। হাতে মামলার ফাইল। ভাবসাবও মহা ব্যস্ত, কাজের খুব চাপ। আদালতে চেম্বার আছ, নিয়মিত বসেনও। ক্লায়েন্ট আসছেন, মামলার দফারফা করছেন। ফাইলিং করে আবার অংশ নিচ্ছেন শুনানিতেও। শুধু জজ কোর্ট নয়, চেম্বার আছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টেও। আছে আইনজীবী পরিচয়ের ভিজিটিং কার্ড। তবে তারা আইনজীবী নন। 

আইনজীবী ছদ্মবেশে টাউট। দেখে বোঝার উপায় নেই, আইনজীবী নন। নেই আইনজীবী সনদও। এমনকি আইন বিষয়ে লেখাপড়াও করেননি। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাত্র এএসসি পাস। তারপরও তারা উকিল। কেউ মামলা লড়ছেন ১০ বছর। 

কেউ কেউ আবার ২০ বছর। দেশের আদালতগুলো প্রতিনিয়তই বিচারপ্রার্থীরা এসব টাউট আইনজীবীর প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ফাঁদে পড়ে অনেকের হাজার হাজার টাকাও গচ্ছা যাচ্ছে কিন্তু আইনি সেবা পাচ্ছেন না। 

থানা থেকে লঞ্চ, রেল থেকে বাস স্টেশন, রাজস্ব অফিস থেকে জেলা প্রশাসকের অফিস, সহকারী কমিশনার ভূমি থেকে রেজিস্ট্রি অফিস, নিন্ম আদালত থেকে উচ্চ আদালত, দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট— এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে টাউট নেই। টাউট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেন ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা’ অবস্থা। 

যেখানেই আইনজীবী ও আইন সেখানেই আছে টাউট। আইনজীবী আর টাউট যেন মাখামাখি অবস্থা। আইনজীবী ও টাউট যেন পাশাপাশি চলে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই টাউট নির্মূলে কাজ করছে আইনজীবী সমিতি। তবুও কাজের কাজ হচ্ছে না। কয়েকদিন পরপরই আদালত প্রাঙ্গণে টাউট ধরা পড়ছে। আটক করে কারাগারেও পাঠানো হচ্ছে। 

তারপরও কমছে না এ টাউটদের দৌরাত্ম্য। আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ অভিযানও চলমান রয়েছে। তবে ফাঁকফোকর গলে দিব্যি প্রতারণা করে যাচ্ছেন ভুয়া আইনজীবীরা। ঢাকার অধঃস্তন আদালত অঙ্গনে টাউট-দালালের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। ন্যায়বিচারের আশায় আদালতে এসে আইনি সহায়তা নিতে গিয়ে টাউট-দালালদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হন অনেকে। তাদের কারণে পেশাগতভাবে হয়রানির শিকার হন আইনজীবীরাও।
 
তবে ঢাকা আইনজীবী সমিতি কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা টাউট-দালালদের উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। দেশের আদালত অঙ্গনে বর্তমানে টাউটের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ঢাকায় আইনজীবীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় টাউটের সংখ্যাও বেশি। শুধু বিচারিক আদালতই নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে বিচারের জন্য এসে পদে পদে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মামলার ফাইল করা, শুনানির জন্য তালিকায় আনা,বেঞ্চে শুনানি করা ও রায় বা আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীদের ভুয়া আইনজীবীর খপ্পরে পড়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। 

আইনজীবীরা বলছেন, দালাল-টাউট বা আইনজীবী না হয়েও আইনজীবী পরিচয় দেয় তাদের জন্য এখন আইনপেশা বিরূপ মন্তব্যের মুখোমুখি। বার কাউন্সিল কর্তৃক এ বিষয়টি যাচাই হওয়াটা একান্তভাবে প্রয়োজন বা সময়ের দাবি। আইন পেশার স্বচ্ছতার স্বার্থে বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়ের ওপর একটি জরিপ করে বিষয়টি যাচাই করতে হবে। 

পাশাপাশি দেশের প্রতিটি জেলা আইনজীবী সমিতিকেও এ ব্যাপারে আরও সোচ্চার হতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে আনার পরপরই বিভিন্ন দালাল ও টাউট গারদখানার সামনে অবস্থান নেয়। এরপর টাউট-দালালের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত নাকাল হতে হচ্ছে তাদের। টাউটদের কারণে পেশাগতভাবে হয়রানির শিকার হন আইনজীবীরাও। এদের কেউ কেউ সমিতি থেকে বহিষ্কার হলেও থেমে নেই তাদের অপতৎপরতা। আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হলে এসব অপকর্মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে পাঁচ মাসে ১০ জ, করোনার দুই বছরে ২৫ জন এবং ২০১৮ সালে ঢাকার নিম্ন আদালতে ৩১ জন টাউট ধরা হয়। তাদের মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু সংখ্যক টাউটকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। 

গত কয়েক মাসে ধরা পড়া কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো : ঘটনা-১. গত ১৯ মে ঢাকার সপ্তম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা শুনানিকালে নুর হোসেন নামে এক টাউটকে আটক করা হয়। কোট-গাউন পরিহিত টাউটকে আটক করে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের টাউট উচ্ছেদ কমিটি। পরে তারা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।  

ঘটনা-২. গত ২০২০ সালের ১২ জুলাই তৃতীয়বারের মতো ঢাকা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটির হাতে ধরা পড়েন শহীদুল ইসলাম (৪৭)। এদিন তার সাথে ধরা পড়েন আরেক টাউট এ কে এম গিয়াস উদ্দিন (৩১)। 

ঘটনা-৩, এদিকে গত ২৭ মে দুপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের গারদের সামনে থেকে মো. রফিকুল ইসলাম জাহাঙ্গীর নামে এক টাউট আইনজীবীকে আটক করে ঢাকা আইনজীবী সমিতিরি টাউট উচ্ছেদ কমিটি। নিয়মানুযায়ী আইনজীবী ব্যতীত অন্য কারো মামলা রিসিভ করার এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও গত ২৬ বছর যাবৎ বিভিন্ন থানা এবং গারদের সামনে থেকে দাপটের সাথে মামলা রিসিভ করে আসছিলেন টাউট জাহাঙ্গীর।  

ঘটনা-৪. বার কাউন্সিলের সনদ ছাড়াই চেম্বার খুলে দীর্ঘদিন যাবৎ দিব্যি নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্র্যাক্টিস করছিলেন নুরনবী নামে এক ব্যক্তি। শুধু জজ কোর্ট নয়, তার চেম্বার আছে সুপ্রিম কোর্টেও। বিচারপ্রার্থীদের সাথে প্রতারণা করে গ্রহণ করছিলেন মামলাও। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গত ১ জুন ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের টাউট উচ্ছেদ অভিযানে ধরা পরেন নুরনবী। এর পরে মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। 

ঘটনা-৫. গত ১১ এপ্রিল সকালে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালত ঘোষিত তালিকাভুক্ত এক টাউটকে আটক করা হয়। আটক টাউটের নাম আবুল কালাম। তিনি ফেনী শহরতলীর বারাহিপুর এলাকার বাসিন্দা। আদালতে আসা বিচারপার্থীদের আইনজীবী সহকারী, ভেন্ডর ও আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছিল। সমিতির টাউট উচ্ছেদ উপ-কমিটির অভিযানে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে তাকে আটক করে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে আর কখনো কোনো ধরনের প্রতারণায় লিপ্ত হবেন না মর্মে মুচলেকা গ্রহণ করে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে ওই প্রতারককে আদালত প্রাঙ্গণে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রচলিত আইনে সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।   

ঘটনা-৬. দীর্ঘ ৩০ বছর আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণা করে আসা আব্দুল বাতেন নামে এক টাউটকে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আটক করা হয়েছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের টাউট উচ্ছেদ অভিযানে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে  ২৪ এপ্রিল তাকে আটক করা হয়। আটক ওই ব্যক্তি আইনজীবী না হয়েও আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন। ওকালতনামায় জাল স্বাক্ষর করে ৩০ বছর ধরে মামলা পরিচালনা করছিলেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আইনজীবী যদি মনে করেন যে, টাউট নির্মূল করতে হবে, তাহলেই টাউট নির্মূল হবে। আইনজীবী সমিতি যেটা করে তা হলো টাউট প্রতিরোধের চেষ্টা। সমিতি টাউটদের ধরে, আইনে সোপর্দ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে টাউটবিরোধী অভিযানের সফলতা-বিফলতা নিয়ে বিতর্কও ওঠে। কেন বিতর্ক ওঠে। টাউট দমনে আইনজীবী সমিতিকে এগিয়ে আসতে হবে।’ টাউট উচ্ছেদ কমিটিতে কাজ করা ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট মো. মশিউর রহমান চৌধুরী (মানিক) বলেন, ‘সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদ কর্তৃক টাউট উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। আইনজীবীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সবার সহযোগিতা কাম্য। অনেক উকিল আর্থিক লাভের আশায় টাউটের কাছ থেকে মামলা গ্রহণ করছেন। মামলা পাওয়ার আশায় অনেক উকিল টাউট লালন পালন করছেন।’