Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রযুক্তি আসক্তিতে বন্দি আমাদের জীবন, নেই প্রকৃতির ছোঁয়া

রাকিব হোসেন মিলন

রাকিব হোসেন মিলন

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম


প্রযুক্তি আসক্তিতে বন্দি আমাদের জীবন, নেই প্রকৃতির ছোঁয়া

একবিংশ শতাব্দীর এই অত্যাধুনিক  যুগে আমরা প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছি। প্রযুক্তির নানাবিধ উপকারিতা থাকলেও অতিমাত্রায় এর ব্যবহার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপদ ঢেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে অত্যধিক হারে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিনোদনে ঝুঁকছেন মানুষ। শিশু, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ ঝুঁকছেন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, টেলিভিশনের দিকে। নিজেদের সময় দেওয়ার বদলে মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিনে বেশি সময় দিচ্ছেন আমরা। নিশ্চিতভাবে বলা যায় প্রযুক্তির জালে বন্দি হয়ে পড়ছে আমাদের স্বাভাবিক জীবন।

ঢাকার কথা চিন্তা করলে তো রীতিমতো বেহুঁশ হয়ে যাবার কথা। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান কমতে কমতে ঢাকা এখন দিন দিন নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছে। শিশুদের খেলার মাঠ, খোলা জায়গার ভীষণ সংকট রয়েছে রাজধানীতে। শহরে স্বল্প জায়গার বাসায় শিশুদের বড় করে তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। ভালো প্যারেন্টিং কি আদৌ সম্ভব এই চার দেয়ালের মধ্যে? অন্যদিকে শিশুদের বিনোদন দিতে বাবা মায়েরা  সহজমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশনের সামনে। বাস্তবতা হলো কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়া আর ঘুম। এ সবের মধ্য দিয়ে সকাল হয়,দিন গড়ায় আবার রাত্রি চলে আসে। প্রকৃত অর্থে এটি কে একটি জড়জীবন বলা যেতো পারে। যেখানে প্রফুল্ল চিত্তে প্রাণের সঞ্চার পাওয়া কঠিন।

গভীর ভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, টেলিভিশনে কার্টুন পছন্দ না হলে মোবাইলে ইউটিউবে চোখের সামনে চলে ভার্চুয়াল জগতের দৌড়ঝাঁপ। এজন্যই ভার্চুয়াল জগতের গতিকেই বাস্তব মনে করে শিশুরা। ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দুটি জাগরিত চোখকে সারাক্ষণ নিবদ্ধ রাখে মোবাইল স্ক্রিন, ল্যাপটপ কিংবা টিভির পর্দায়। তাছাড়া বই পড়াতেও নেই আগ্রহ তাদের।

বাস্তবতা হলো গ্রামের মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের বেড়ে উঠার জন্য খুবই সহায়ক। গ্রামের খোলা জায়গায় শিশুরা হেসে-খেলে কিছুটা সময় কাটাতে পারে। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারে। রাজধানীর চার দেয়ালের বাসায় ঠিকমতো আলো-বাতাস  ঢোকে না। দিনের পর দিন ছেলেমেয়েদের কীভাবে আটকে রাখা সম্ভব? বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশেষ সতর্কতার কারণে বাসার ছাদেও যাওয়ার অনুমতি মিলছে না শিশুদের জন্য।

বাচ্চাদের কে কিছুদিন বই পড়তে উৎসাহিত করা যায় বটে। কিন্তু অনলাইন থেকে কিছুতেই দূরে রাখা যায় না। বাধ্য হয়েই ফোন হাতে তুলে দিতে হচ্ছে তাদের হাতে। কারণ সময়ই তো কাটছে না।কোনো না কোনো ভাবে সময় তো কাটাতে হবে। তখন শেষ অস্ত্র হলো অনলাইনে সময় কাটানো। শুধু শিশুরা নয়, সব বয়সী মানুষের প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা।

অনেকক্ষণ ধরে স্ক্রিনে থাকার কারণে সবার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে থাকে এবং কথা বলতে ভালো লাগে না। চোখ টনটন করতে থাকে, ঘাড় ব্যথা করে, হাত অবশ হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এতে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কিন্তু কম নয়। একটি উঁচু মানের গবেষণায় দেখা যায়, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন না বা কম করেন,  তাদের চেয়ে যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করেন বা বেশিই ব্যবহার করেন তাদের মেজাজ বেশি খিটখিটে এবং অস্থির মনের হয়ে থাকেন। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা অনেক সময় চিন্তা করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাবো না। কিন্তু একবার চালাতে শুরু করলে আর বের হতে পারি কি? দেখা যায় বাসার মধ্যে বাবা ল্যাপটপে অফিসের হোম ওয়ার্ক করেন, মা আর ভাই নেটফ্লিক্সে মুভি দেখেন। বস্তুত পরিবেশটা এমন হয়ে গেছে যে, খাওয়ার টেবিল ছাড়া আমাদের পারস্পরিক একত্রে কথা বলার সময়ই পাচ্ছি না। অনেকে আবার খেতে বসেও ইন্টারনেট নিয়ে বসে থাকেন। ইন্টারনেট আমাদের জন্য চরম আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। সত্যি কথা হলো, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা দিন দিন অসামাজিক হয়ে পড়ছি। বাস্তবতা হলো সব বুঝতে পারি তবুও এই আসক্তি থেকে আমরা বের হতে পারছি না।

বিশেষ করে করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। সম্প্রতি এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির মূল প্রতিষ্ঠান মেটা জানায়, ফেসবুকে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যায় গোটা পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তিনে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২৩  সালের জানুয়ারিতে ছিল প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৪৮ হাজার। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করে। যার মধ্যে পুরুষ ব্যবহারকারী প্রায় ৬৮ শতাংশ। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি (৪৪ শতাংশ) ফেসবুক ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৬২ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত; যা উদ্বেগজনক। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালে ৫২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবককে নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড-১৯-এর সময় অনেক বাংলাদেশি যুবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে, যারা বর্তমানে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছে। আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফেসবুকে আসক্ত। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ডা. এম মোহিত কামাল বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য তরুণকে আমরা মানসিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ার মতো বাস্তবেও সবকিছু ওভাবেই পেতে চায়। এতেই বাধে বিপত্তি। এখন সব বয়সী মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের আসক্তি বেড়েছে। মাদকের চেয়ে কোনো অংশে এই আসক্তি কম নয়। মানুষজন ঘুম কমিয়ে মনকে অসুস্থ করে দিচ্ছে অত্যধিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। তাই সুস্থ থাকতে হলে পর্যাপ্ত ঘুম মানব দেহের জন্য খুবই জরুরি। আসুন প্রয়োজন ব্যতীত ইন্টারনেট ব্যবহার না করি। সময় অপচয় না করি। উদ্দেশ্য বিহীন শুধু শুধু ইন্টারনেট স্ক্রোলের মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো অযথা সময় খরচ ও বেহিসেবি আচরণের জন্য কিন্তু আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাব দিতে হবে। আসুন সুযোগ পেলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে একটু ঘুরে আসি, প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিই,মন খুলে হাসি। জীবনতো অনেক ছোট। এই ছোট্ট জীবনকে অযথা প্রযুক্তির জেলখানায় নিজেদের বন্দী করতে যাবো কেনো?

Link copied!