নভেম্বর ৮, ২০২৩, ১২:১১ এএম
- আগামী সপ্তাহে অসহযোগ আন্দোলন ও বিশেষ বার্তায় বৃহৎ অবস্থান
- তৃণমূলের নেতা দিয়ে আন্দোলনের কঠিন ছক রয়েছে বিদেশি বার্তাও
- মাঠ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে সরাসরি যোগাযোগ চলছে
- গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে চিন্তিত নয়, তাৎক্ষণিক দেয়া হচ্ছে দায়িত্ব
দলের হাইকমান্ডসহ শীর্ষ নেতারা আটক হলেও চিন্তিত নয় বিএনপি। নির্বাচনকে সামনে রেখে হার্ডলাইনে রয়েছে দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘরে না আসা পর্যন্ত কর্মসূচিতে বিরতি না দেয়ার কৌশলে রয়েছে তারা। এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যেতে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বার্তা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আর মাত্র দুই মাস বাকি। ৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সাক্ষাৎ করবে। এরপর নির্বাচন কমিশনের বৈঠক ডেকে এ মাসের মধ্যভাগেই তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি মনে করছে টানা আন্দোলনে থাকতে পারলে তফসিল ঘোষণা খুব একটা সহজ হবে না। কিংবা তফসিল হলেও সরকার এবার একচেটিয়া উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তৃণমূলে আন্দোলনের কঠিন ছক ও বিদেশি কিছু ইঙ্গিতে এবার রাজপথ ছাড়বে না দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি।
বিএনপি জোটের শীর্ষ দুটি দলের প্রধান আমার সংবাদকে বলেছেন, বিএনপি এখন যে গতিতে চলছে আরও এক সপ্তাহ এভাবে চলবে। এরপর তারা জামায়াত-চরমোনাইসহ সবাই যে কোনো মুহূর্তে এক ব্যানারে নেমে আসবেন। এখন বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটলে নিজ নিজ দলের ওপর দায় আসতে পারে, তাই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কেউ মাঠে নামছে না। জামায়াতও শুধু ব্যানার পলিটিক্স করছে। বিএনপির সঙ্গে যখন জামায়াত ও চরমোনাই এক ব্যানারে চলে আসবে তখন সবাই এক উদ্দেশ্য নিয়েই মাঠে থাকবে। আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ দেখানো হবে। রাজপথে থেকে দাবি আদায় করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে তবেই সব দল মিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। হরতাল-অবরোধ ছাড়াও অসহযোগ আন্দোলন কিংবা অঘোষিত বার্তায় বৃহৎ অবস্থানেরও প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আগামী সপ্তাহের যে কোনো দিন অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা আসছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রটি বলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ শীর্ষ নেতারা আটক হওয়ার পর মধ্যম সারির নতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিএনপির হাইকমান্ডের বার্তা অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতা এবং থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদেরকেই মাঠে কর্মসূচি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারাগারের বাইরে থাকা সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি আলোচনা করে নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে তা ধরে নিয়ে আগেই প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতাদের বাইরে তৃণমূলে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের দিয়ে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় হরতালের পর অবরোধ কর্মসূচিও সারা দেশে সর্বাত্মকভাবে পালিত হওয়ায় সন্তুষ্ট দলটির হাইকমান্ড। তারা মনে করছেন, বিরোধী জোটের চলমান আন্দোলনে সাধারণ মানুষের নীরব সমর্থন রয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও বিএনপি এমন বিপর্যয়ে পড়েছিল। তখনও গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক সিনিয়র নেতা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তৃণমূল নেতাকর্মীরাই বিএনপির হাল ধরে রেখেছিলেন। এবারও একইরকম বিপর্যয়ে পড়েছে বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেকে ফোন বন্ধ রেখে গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে আন্দোলন বাস্তবায়নে তৃণমূল নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেজন্য কেউই মনোবল হারায়নি। থানার নেতারা গ্রেপ্তার হলে ওয়ার্ডের নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিএনপির ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের গ্রেপ্তারের পরপরই ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে আরেকজনকে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান কারাগারে থাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, তানভীর আহমেদ রবিন গ্রেপ্তারের পর লিটন মাহমুদকে ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব করা হয়েছে। মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হককে গ্রেপ্তারের পর যুগ্ম আহ্বায়ক এ জি এম শামসুল হককে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন গ্রেপ্তার হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হয়েছেন ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর। এভাবে জেলা থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব দেয়া হচ্ছে।
চূড়ান্ত দৃষ্টি রেখে সরকারের নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রক্রিয়ায় তারা এবার পা দিচ্ছে না। তারা মনে করছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। এটির চূড়ান্ত একটি ফয়সালা আসবে। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে ৪ অক্টোবর নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ (ইনু) ২৬টি দল ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিলেও বিএনপি জোটসহ ১৮টি দল যায়নি। ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে চরমোনাইয়ের ইসলামী আন্দোলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে বিএনপি-জামায়াতসহ সবাইকে নিয়ে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা।
এদিকে দুই দফায় পাঁচ দিনের অবরোধ শেষে আবারও সারা দেশে দুই দিনের সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। আজ বুধ ও বৃহস্পতিবার এই অবরোধ হবে। অর্থাৎ বুধবার ভোর ৬টা থেকে অবরোধ শুরু হয়ে শুক্রবার ভোর ৬টায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হবে। গত সোমবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে হামলা ও পণ্ড করা, হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ এবং সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অবরোধের কর্মসূচি দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে বিএনপি ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, হামলা-মামলার চিত্র তুলে ধরেছে বিএনপি। মোট গ্রেপ্তার প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী, মোট মামলা ১৬টি, মোট আসামি এক হাজার ৭২৮ জনের অধিক নেতাকর্মী (এজাহার নামীয়সহ অজ্ঞাত) এবং মোট আহত ৪৮ জনের অধিক নেতাকর্মী।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে অদ্যাবধি মোট গ্রেপ্তার আট হাজার ৯৫১ জনের অধিক নেতাকর্মী, মোট মামলা ১৪৮টির অধিক, মোট আহত তিন হাজার ৫৬৬ জনের অধিক নেতাকর্মী এবং মৃত্যু ১১ জন (সাংবাদিক একজন)। আগামী দিনের আন্দোলন সম্পর্কে বিএনপির মুখপাত্র ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন চলছে। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আমাদের হার্ডলাইনে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। দেশের মানুষ এখন খেতে পারছে না। কেউ আর এই সরকারকে চায় না। তাই সারা দেশের মানুষ এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। সামনে আরও কঠোর কর্মসূচি আসবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার নির্মম জুলুম-অত্যাচার অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার-আটকও তারা নির্বিচারে চালিয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কিন্তু জনরোষ আরও তীব্র হচ্ছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা আরও আকাশচুম্বী হয়েছে। কাজেই সরকার যেটা ভেবেছিল যে এই আন্দোলন বলপ্রয়োগ করে স্তব্ধ করে দেবে এবং নেতাদের বন্দি করে ফেললেই সবাই চুপচাপ ঘরে ফিরে যাবে, সেটা ইতোমধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিকামী মানুষের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলতেই থাকবে যতক্ষণ না আমাদের এক দফা দাবি অর্জিত হয়।’