Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

খতনা নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবক

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪, ১২:৩৭ এএম


খতনা নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবক
  • সম্প্রতি হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যু
  • অভিভাবকরা অনেকে পুরোনো হাজাম পদ্ধতিতে খতনার কথা ভাবছেন
  • শিশুদের অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়ার তাগিদ

মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় খতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে কোনো শিশুর মৃত্যু কাম্য নয় 
—অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ

রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা আসমাত আরা বেগম। তার ছোট ছেলের বয়স পাঁচ বছর। এ বছরই স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। আসন্ন রমজানে স্কুল বন্ধের সময় ছেলেকে খতনা করাবেন বলে পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু সামপ্রতি দেশে খতনা করাতে গিয়ে হাসপাতালে দুই শিশুর মৃত্যুতে তিনি শঙ্কিত। তার সাথে কথা হয় আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। ছোট ছেলেও এসব দেখে খতনা করাতে ভয় পাচ্ছে।

আশফাকুল ইসলাম একজন বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। দুদিন আগে নিজের বাসায় ছয় বছর বয়সি ছেলেকে খতনা করিয়েছেন রেজিস্টারভুক্ত হাজাম দিয়ে। হাজামের পরামর্শে খতনা পরবর্তীতে ওষুধ খেয়ে ভালো আছে তার ছেলে। তার সাথে কথা হয় আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম হাসপাতালে নিয়ে ছেলেকে খতনা করাব। খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর পর আর হাসপাতালে নিয়ে খতনা করানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। সামপ্রতিক সময়ে খতনা করাতে গিয়ে সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ান ও মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে আয়হাম নামে দুই শিশু মৃত্যুর পর খতনা নিয়ে এমনই আতঙ্ক দেখা গেছে অভিভাবকদের মধ্যে। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ঘুরে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে খতনা নিয়ে এমন আতঙ্কের কথা জানতে পারেন। অভিভাবকদের কেউ কেউ হাসপাতালে আধুনিক খতনা পদ্ধতি থেকে সরে এসে পুরোনো হাজাম পদ্ধতিতে খতনার কথা ভাবছেন।

খতনা নিয়ে আতঙ্ক শুরু হয় মূলত গত ডিসেম্বর মাসে। সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানকে খতনা করাতে নিয়ে আসেন তার বাবা। খতনা করানোর সময় অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়ার কারণে আর জ্ঞান ফেরেনি শিশু আয়ানের। পরে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা হয়নি। আট দিন অচেতন থাকার পর গত ৭ জানুয়ারি রাতে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে সমালোচনার ঝড় তোলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। খতনা নিয়ে আরও আতঙ্ক বাড়ে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়হামকে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যুতে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে আয়হামকে সুন্নতে খতনা করাতে নিয়ে যান তার বাবা ফখরুল আলম। স্থানীয় অ্যানেস্থেসিয়া না দিয়ে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয় শিশুটির শরীরে। এতে খতনা করানোর পর আর জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও সন্তানকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের না করায় তিনি নিজেই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেন। গিয়ে দেখেন সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে। নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এরপর ফখরুল আলমকে ওটি থেকে বের করে দেন চিকিৎসকরা। দুই ঘণ্টা পরে জানানো হয় আয়হামের মৃত্যু হয়েছে। পরে হাতিরঝিল থানায় চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলায় জেএস হাসপাতালের তিন চিকিৎসককে আসামি করা হয়। চিকিৎসক দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

ঘটনা দুটির পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতাল ক্লিনিকের ক্ষেত্রে ১০টি নির্দেশনা জারি করা হয়। যেকোনো ধরনের অপারেশন বা প্রসিডিউরের জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বারে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপারেশন/সার্জারি/ইন্টারভেনশনাল প্রসিডিউর করা যাবে না। সব বেসরকারি নিবন্ধিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিকে লেবার রুম প্রটোকল অবশ্যই মেনে চলতে হবে। নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটারে অবশ্যই অপারেশন থিয়েটার শিষ্টাচার মেনে চলাতে হবে। অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা বলছেন, অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর যত দুর্ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে শর্ট কেসের (ছোট অপারেশন) ক্ষেত্রে। সারা বিশ্বে যদি বছরে ভুল অ্যানেস্থেসিয়ায় পাঁচ হাজার মানুষেরও মৃত্যু হয়, সেখানে দেখা যাবে সাড়ে চার হাজারই ছোট কেস আর অবহেলায় মৃত্যু। শিশুদের অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর চেকআপ করতে হয়। বারবার অবজারভেশন করতে হয়। কেন মৃত্যু হচ্ছে এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। অবশ্যই পেশাগতভাবে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট দিয়ে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে দুই শিশুর মৃত্যু ও দেশে খতনা ব্যবস্থা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সাথে কথা বলেন আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক। তিনি বলেন, আমাদের দেশ মুসলিম প্রধান দেশ, এখানে খতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতি বছর লাখ লাখ খতনা হচ্ছে দেশে। কিন্তু খতনা করানো নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। এতে করে কারা কিভাবে খতনা  করাচ্ছেন এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। খতনা নিয়ে একটি নীতিমালা হওয়া জরুরি। খতনা করাতে গিয়ে কোনো শিশুর মৃত্যু হলেই ডাক্তারকে দোষারোপ করা যাবে না। সুনির্দিষ্ট কারণ  খুঁজতে হবে। কোনো শিশুর মৃত্যুই কাম্য নয়।
 

Link copied!