ফেনীতে নির্মম গণহত্যার এক বছর আজ

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, ফেনী প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ০১:৫১ পিএম
ফেনীতে নির্মম গণহত্যার এক বছর আজ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফেনীর মহিপালে সংঘটিত নির্মম গণহত্যার এক বছর পূর্ণ হলো আজ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক আগের দিন, ২০২৪ সালের ৩৫ জুলাই (৪ আগস্ট) দুপুরে মুহুর্মুহু গুলিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ফেনীর মহিপাল এলাকা।

সেদিন আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সদস্যরা সরাসরি গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রাবণ, মাসুদ, শিহাব, সাইদুল, সাকিবসহ ১১ জন প্রাণ হারান।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নন—এই ঘটনায় পথচারী, শ্রমজীবী এবং সাংবাদিকসহ দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। রক্তাক্ত হয় ফেনীর রাজপথ, সৃষ্টি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।

বেলা সাড়ে ১১টায় শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ‘এক দফা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহিপাল অংশ দখলে নেয় শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। দুপুরে আন্দোলনকারীদের অনেককে মহাসড়কেই জোহরের নামাজ আদায় করতে দেখা যায়।

একই সময় শহরের ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্বর, খেজুর চত্বর ও শহীদ মিনার এলাকাজুড়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা। দুপুর দেড়টার দিকে মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে তারা অতর্কিতে হামলা চালায় নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর। মুহুর্মুহু গুলিতে ঘটনাস্থলেই ৮ জন নিহত হন।

ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আসিফ ইকবাল সেই দিনের বিভীষিকার স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, “৪ আগস্ট দুপুর আড়াইটার পর থেকেই হঠাৎ করেই রোগী আসা শুরু হয়—কেউ নিয়ে এলো মরদেহ, কেউ গুরুতর আহত। ইমার্জেন্সিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। জীবনে একসঙ্গে এত মরদেহ আর কখনও দেখিনি।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, “৪ আগস্ট সকাল ১১টায় কর্মসূচি শুরু হয়। জোহরের নামাজের পর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই ৮ ভাই শহীদ হন।”

তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে দেশে মৌলিক সংস্কার ও গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।”

শহীদ শ্রাবণের পিতা নেছার আহম্মদ বলেন, “অনেক আসামি বিদেশে পালিয়ে গেছে, আবার যারা দেশে আছে তাদের অনেকেই এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বিচার না হলে হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে।”

শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, “৪ আগস্টের পর থেকে আমাদের জীবন থেকে সব আনন্দ চলে গেছে। সেদিনই আমাদের গোছানো সংসার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এখন আমাদের একটাই চাওয়া—ন্যায়বিচার।”

এই গণহত্যা নিয়ে দায়ের করা একাধিক মামলার আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভুঞা বলেন, “সেদিনের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে অস্ত্রধারীরা যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালায়, সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে তাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হিসেবেই শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু ৬১৯৯ জন আসামির মধ্যে প্রভাবশালী অনেকেই এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।”

ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান জানান, “ঘটনার পর ২২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জন এজাহারনামীয় এবং ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। ইতোমধ্যে ১ হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।”

তিনি আরও জানান, একটি হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং নিজাম হাজারীসহ ২২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, “২০২৪ সালের আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ফেনী শহরের মুক্ত বাজার এলাকায় 'জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ' নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়াও সদর হাসপাতাল চৌরাস্তার কাছে 'জুলাই ২৪ শহীদ চত্বর' নির্মাণ করা হয়েছে।”

ইএইচ