সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২, ০৩:০৩ এএম
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। যেখানেই নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন, সেখানেই কমিশন। এমন কথা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে চলছে গণমানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করা রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। দেশে শিশু নির্যাতন, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, গুম, মিথ্যা মামলা, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হেফাজতে নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করার কথা মানবাধিকার কমিশনের। তবে কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।
মানবাধিকার কমিশন বলছে, নানা ধরনের সংকট নিয়েই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। নিজস্ব কার্যালয় নেই। রয়েছে জনবলের অভাব। কমিশনের লোকবল মাত্র ৬৫ জন। এত কম জনবল নিয়ে ব্যাহত হচ্ছে কমিশনের তদন্তকাজ। অর্থ ও প্রয়োজনীয় উপকরণও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। নেই জেলাভিত্তিক কার্যালয়ও। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ কমিশনে দাখিল করতে হলে রাজধানীতে যোগাযোগ করতে হয় ভুক্তভোগীদের। আইনে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে অফিস করার বিধান থাকলেও তার কোনো উদ্যোগ নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন ও পেনশন সুবিধাও নেই। তাই কেউ কমিশনে চাকরি করার আগ্রহ দেখান না। এছাড়া কমিশনের তাগাদা থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল হয়নি অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।
অভিযোগ রয়েছে, গুম, ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবিতে জাতিসংঘের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার থাকলেও এ ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা অনেকটাই নীরব। বিচারবহির্ভূত হত্যা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধে বর্তমান কমিশনের পক্ষ থেকে জোরালো বা দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। আলোচনা-সমালোচনার পরও নিশ্চুপ থাকে কমিশন। এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পার হলেও এখনো কমিশনের আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদ্যমান আইনে সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি অস্পষ্টতাও রয়েছে। এ কারণে অনেক্ষ ক্ষেত্রেই কমিশন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বর্তমানে কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না, শুধু সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে কার্যক্রম। আবার কী সুপারিশ করা হয়, তা প্রকাশ করারও বাধ্যবাধকতা নেই। সরাসরি তদন্ত করারও ক্ষমতা কমিশনের নেই। কমিশনে অভিযোগ করতে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় বিচারপ্রার্থীকে।
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, জনগণের ভরসা ও আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি মানবাধিকার কমিশন। বিশেষ করে বর্তমানে কমিশনের ভূমিকায় মানুষের আস্থার জায়গা আরও নড়বড়ে হয়ে গেছে। কমিশন স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। কমিশনের ক্ষমতা কম। কিন্তু যতটুকু আছে, তাও তারা প্রয়োগ করে না। কমিশন একটি সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই আছে। কিন্তু তাদের সুপারিশের যথাযথ বাস্তবায়ন চিত্র কখনোই দেখা যায়নি।
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগের হার ও নিষ্পত্তির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১ সালে এক হাজার ২৭১টি অভিযোগের মধ্যে ৯৭২টির নিষ্পত্তি হয়েছে। কমিশন বিশ্বাস করে, এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি, সরকার, উন্নয়ন সহযোগীরা কমিশনের ২০২১ সালের অর্জন সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সামগ্রিক ধারণা পাবে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক ভার্চুয়াল সভায় আলোচকরা বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি জানেই না তার ক্ষমতা কতটুকু। এই প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত যে আইনটি আছে, সেটাও তারা জানে না। অপরাধ ও মানবাধিকারের মধ্যে যে ফারাক, তাও তারা নিশ্চিত করতে পারে না।
বার্ষিক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, প্রতিবেদনে কমিশনের নানা সাফল্য এবং সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে একাধিক সুপারিশও দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, কমিশনের আইন সংশোধন, নিজস্ব অফিস স্থাপন, জনবল নিয়োগসহ অন্য বিষয়গুলোর প্রতি পদক্ষেপ নিতে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশন কি কাজ করছে? এ কমিশনের আউটপুটই বা কি? সমাজে কি এই কমিশনের কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে? যে উদ্দেশ্য নিয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তা কি বাস্তবায়ন হচ্ছে? কমিশন আইনের ১৯(২) ধারার বিধানমতে, কমিশন কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারে। সরকার যদি ওই সুপারিশ না মানে, তাহলে কমিশন আইনের ১৯(১)(খ) ধারা অনুযায়ী ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করতে পারে। কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে এ রকম কোনো কার্যক্রম লক্ষ করা যায় না।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, এটি নখ-দন্তহীন কমিশন। তাদের হাত-পা বাঁধা। কমিশনকে আমলাদের একটা পুনর্বাসনস্থল করে ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টেরও একটা রায় আছে। তাই স্বাধীনচেতা কিছু মানুষ যদি এর পরিচালনার ভারে না থাকেন, তা হলে এ কমিশন থেকে বেশি কিছু হবে না। কমিশনের কাজ তো মানবাধিকার রক্ষা করে সরকারকে সাহায্য করা। রাষ্ট্রের যেসব সংস্থা বা ব্যক্তি ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন, তাদের বিরুদ্ধে নিরীহ জনগণের পাশে দাঁড়ানোই মানবাধিকার কমিশনের কাজ। কমিশন যদি মনে করে কিছু করলে বা কোনো বিবৃতি দিলে সরকার নাখোশ হবে, তাহলে সেখানেই মানবাধিকার কমিশনের মৃত্যু ঘটে।