Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪,

বিফল রোডম্যাপে নতুন প্রশ্ন

আবদুর রহিম

এপ্রিল ৪, ২০২৩, ০৭:৪৬ এএম


বিফল রোডম্যাপে নতুন প্রশ্ন

ইভিএমের বদলে ব্যালটেই ৩০০ আসনে ভোটের ঘোষণা

 

ব্যালটেও যে ভোট সুষ্ঠু হবে না— এটিও বলা ঠিক নয়

—আব্দুর রউফ, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার

 

আমরা অতীতে ব্যালটের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোট করেছি

—কবিতা খানম, সাবেক নির্বাচন কমিশনারর

 

এই কমিশনে রাজনৈতিক কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আস্থা নেই

—বদিউল আলম মজুমদার, সুজন সম্পাদক   

 

এ কমিশন সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছুই করছে না

—শামা ওবায়েদ, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক

 

মাত্র সাড়ে ছয় মাসে ভেস্তে গেলো নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ। ১৫০ আসনেও হচ্ছে না ইভিএমে ভোট। আর্থিক সংকট ও রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছে। যদিও গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইসির রোডম্যাপ উপস্থাপনকালে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছিলেন, ‘ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে ভোটের আগে-পরে ইচ্ছেমতো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করা সম্ভব।’ ভোট কলঙ্ক মুছতে ইভিএমের উদ্যোগ নিয়ে এবার হাবিবুল আউয়াল কমিশনও হোঁচট খেলো বলে বলছেন বিশ্লেষকরা। গতকাল কমিশন জানিয়েছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ব্যালটে ভোট হবে। ইভিএম কিনতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে এর পেছনে ভিন্ন রহস্য দেখছেন রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার ইসি আভাস দিয়েছে, আগাম নির্বাচনের। সংবিধান অনুসরণ করে ইসি হয়তো রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর কৌশল নিচ্ছে। কিন্তু তার চারদিন পর গতকাল আবার ব্যালটেই ভোট হবে বলে রোডম্যাপ বিপর্যয়ের নতুন খবর জানাল ইসি। এতে করে ইসি হয়তো রাজনৈতিক দূরত্ব নিরসনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। গত বছরের আগস্টে ইসির আহ্বানে রাজনৈতিক সংলাপে জাতীয় পার্টিসহ ১৪টি দল ইভিএমের বিপক্ষে কথা বলেছে। আওয়ামী লীগসহ মাত্র চারটি দল সরাসরি ইভিএম চেয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপিসহ ৯টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করে। শুরু থেকেই রাজনৈতিক বিভাজন চলছে এভিএম নির্বাচন নিয়ে। তাই অনেকে ধারণা করছেন, কমিশন হয়তো পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করছে। বিরোধীদের দাবি ও মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে এক মঞ্চে আনতে চেষ্টা করছে। তবে সরকার বিরোধীদের ভাষ্য ভিন্ন, তারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে ইসি কিছুই করছে না। ব্যালটে ভোট হলে অতীতের মতো পুরোনো স্টাইলে রাতের বেলায় বাক্স ভর্তি করতে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বেশি সহজ হবে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সকাল সাড়ে ১০টায় কমিশনের ১৭তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সভায় অন্য চার কমিশনারসহ ইসি সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার হবে না।  আগামীতে ৩০০টি আসনে ব্যালট পেপার ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেইভিএম মেরামতের জন্য যে এক হাজার ২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল, সে অর্থ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার কারণে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার চলমান থাকবে।

ইসি সচিব বলেন, ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবও নেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পটি আর গৃহীত হয়নি। ইভিএমের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিএমটিএফ এক লাখেরও বেশি ইভিএমের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রস্তাব করে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। নির্বাচনের আগে সময় স্বল্পতা ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ পেতে নিশ্চয়তা না পাওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। সব বিষয় বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেও ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা নিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। কিন্তু সরকারের সায় না পাওয়ায় ইসির প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। পরে ইসির হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ করে অন্তত ৫০ থেকে ৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট করার সক্ষমতা ছিল ইসির। ইভিএম মেরামতেও হাজার কোটি টাকার সংস্থান চাওয়া হয়। তাতেও আর্থিক সংকটের কারণে অর্থ পেতে সংশয় দেখা দেয়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রউফ আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘ইভিএমেই ভোট হবে এমন ঘোষণাই ইসি দিয়েছিল। এখন হঠাৎ করে কেন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলো না এর পেছনে কী রহস্য রয়েছে, এটি একমাত্র নির্বাচন কমিশনাররা ভালো বলতে পারবেন। এগুলো আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে ব্যালটেই যে ভোট সুষ্ঠু হবে না এটিও বলা ঠিক নয়। এখন তারা কিভাবে নির্বাচন করবে, কেমন নির্বাচন করলে গ্রহণযোগ্য হবে, এটি তারাই ভালো বলতে পারবে।’ প্রকল্প বাদ পড়াতে কোনো প্রভাব পরবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইসি অবশ্যই সব দিক বিবেচনা করেছে সরকারকে জানিয়েছে ভালো-মন্দের সঠিক কারণ তারাই বলতে পারবে।’

সাবেক আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘আমাদের সময় ইভিএম ছিল না। আমরা ব্যালটের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোট করেছি। এটি এমন তো নয়, ব্যালটে ভোট হলে গ্রহণযোগ্য হবে না। মাঠ প্রশাসন ভালো থাকলে ব্যালটের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। এ জন্য মাঠ প্রশাসনকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে এখন থেকে প্রস্তুত করতে হবে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘এই কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট নাগরিক-ব্যক্তিদেরও আস্থা নেই। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হয় তাহলে হামলা-মামলা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে এবং সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ইভিএমতো আগে থেকেই বিতর্কে ছিল। এখন ব্যালটের সিদ্ধান্তে এসেছে তাতেও যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে গ্রহণযোগ্য হবে তা বলা যায় না।’

জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ আমার সংবাদককে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন পরে হলেও বুঝতে পেরেছে, আসলে ইভিএমে ভোট করতে হলে যে ধরনের প্রযুক্তি কিংবা সাপোর্ট দরকার তা নেই। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপি প্রমাণ হয়েছে— ইভিএমে ভোটের ফলাফল পবিবর্তন করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপ প্রকাশকালে বলেছিল, ব্যালটে ভোট হলে বাক্স ভর্তি করা সম্ভব। তার মানে তারাই স্বীকার করল— ২০১৮ সালের ভোট রাতের বেলায় প্রশাসন ও দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়েই হয়েছে। সেই ভোট সুষ্ঠু হয়নি। 

দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু ভোট হতে পারে না। এ দেশের জনগণ এখন বিশ্বাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই গ্রহণযোগ্য ভোট হতে পারে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ কমিশন সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছুই করছে না। ইসির এ সিদ্ধান্তের পেছনে কৌশলও থাকতে পারে, তবে বিএনপি তাদের কোনো কৌশলে পা দেবে না।’

 

Link copied!