Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪,

ডেঙ্গুতে বাড়ছে মৃত্যু উদ্বেগ

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জুলাই ৫, ২০২৩, ১২:১৯ এএম


ডেঙ্গুতে বাড়ছে মৃত্যু উদ্বেগ

আগামী দুই মাস বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রমও চালানোর কথা বলছেন কীটতত্ত্ববিদরা

করোনা মহামারির আগের বছর দেশজুড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ওই বছর সারা দেশে লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। প্রাণ হারান প্রায় তিন শতাধিক। করোনার বছর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে এলেও এবার যেন আগের স্মৃতি মনে করাচ্ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু পরিস্থিতি। সাধারণত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও চলতি বছর জুলাই মাসের আগেই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, যা আক্রান্তের সংখ্যায় গেলো বছরের তুলনায় ৯ গুণ বেশি। এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে ঢাকা উত্তর সিটি পুরোনো পদ্ধতি ফগিংয়ে ভরসা রাখলেও ঢাকা দক্ষিণ হাতে নিয়েছে নতুন কর্মসূচি। 

সিটি কর্পোরেশন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি ডেঙ্গু মশা (প্রজনন) বিস্তারে সহায়ক। কারণ, পরিষ্কার পানিতে এই মশার জন্ম হয়। এমন পরিস্থিতিতে নগরবাসীর সহযোগিতার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা। এডিস মশার প্রজননকেন্দ্র ধ্বংস করতে বিশেষ চিরুনি অভিযানও পরিচালনা করছেন তারা। নেয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি। প্রায় সারা বছরই রাজধানীবাসীকে ডেঙ্গুবাহিত এডিস ও কিউলেক্স মশার উপদ্রব সহ্য করতে হয়। ক্ষুদ্র এই মশার কামড়ে প্রতিবছর প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। মশা নিধনে দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তেমনটা কাজে আসছে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো প্রাণঘাতী মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এডিস মশা নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে যে কোনো পরিবেশে। এ নিয়ে যথেষ্ট গবেষণারও ঘাটতি রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ের অনুমেয় ‘হটস্পট’ সামলাতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ভয়াবহ হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। চলতি মাসের গত চার দিনেই ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল বেশি। আর বর্ষার শুরুতেই সে প্রকোপ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জুলাইয়ের চার দিনে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪ জন। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার এক দিনেই এ রোগে দেশে মারা গেছেন পাঁচজন। যা এ মৌসুমের এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। শুধু মৃত্যুই বাড়েনি, বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যাও। গত চার দিনে এক হাজার ৮৯৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৭৮ জন। এ সময় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ৪২৯ জনকে। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২৪৯ জনকে। ডেঙ্গুর পিক সিজন বলা হয় বর্ষার এ মৌসুমকে। এরই মধ্যে ঢাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে তিন দিনব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এ অভিযানে সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন ভবনে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা শনাক্তেও যাচ্ছেন কর্পোরেশনের-সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে এক হাজার ৬৬৯ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩ হাসপাতালে ভর্তি আছে এক হাজার ১০০ জন। ঢাকা ছাড়া অন্য বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগী ৫৬৯ জন। চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে গত জুন মাসে। জুনে দেশে ৩৪ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন। চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৮৭১ জন। এর মধ্যে ঢাকায় সাত হাজার ৮৪ এবং ঢাকার বাইরে দুই হাজার ৭৮৭ জন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে চলতি বছর হাসপাতাল ছেড়েছেন আট হাজার ১৪১ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগী পাঁচ হাজার ৯৩৬ এবং ঢাকার বাইরে দুই হাজার ২০৫ জন।  নতুন করে পাঁচ মৃত্যু নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলো ৬১ জনের।

উত্তর সিটির যত উদ্যোগ : বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিরসন ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্ট বিভাগ, শাখাসমূহের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মাস্টার রোল শ্রমিকদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সোমবার নগর ভবনে এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ডেঙ্গু যাতে কোনোভাবেই ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। বাসার ভেতর, ছাদ ও বারান্দায় কোথাও কোনো পাত্রে যেন পানি না জমে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আরও বলেন, টানা ভারী বৃষ্টির কারণে শহরে অনেক জায়গায় পানি জমে থাকে। দ্রুত সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসন করে জনগণকে স্বস্তি দিতে কর্মীদের সার্বক্ষণিক মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ, পলিথিনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ড্রেনে ফেলবেন না। এগুলো ড্রেনে ফেলায় ব্লক হয়ে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। সবাই সচেতন হলে কাজটা আমাদের কর্মীদের জন্য সহজ হয়ে যায়। ধোঁয়া দিয়ে মশা মারার পদ্ধতি (ফগিংয়ের মাধ্যমে পরিপক্ব মশা নিধন) ‘ভুল’ বলে জানা গেলেও ডিএনসিসি সে নিয়মে এবারও মশার ‘হটস্পট’ ধ্বংসে কাজ করছে। এতে মশা মরা তো দূরের কথা, উল্টো অর্থ নষ্ট হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

দক্ষিণ সিটির যত উদ্যোগ : এডিস মশা নিধনে তিন দিনব্যাপী বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। আগামী ৬ জুলাই পর্যন্ত এই চিরুনি অভিযান চলবে বলে জানা গেছে। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জানান, এডিস মশার প্রজননস্থল নিধনে দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডে তিন দিনব্যাপী বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু হয়েছে। গতকাল ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বলধা গার্ডেন এলাকায় এ অভিযানের উদ্বোধন করেন। এলাকাভিত্তিক মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিদিনের ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে অভিযানের জন্য ওয়ার্ডগুলো ঠিক করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল ডিএসসিসির পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে ১২টি মামলায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড আরোপ ও আদায় করা হয়েছে। ডিএসসিসির সিইও মিজানুর রহমান বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন, সেখান থেকে রোগীদের বাসার ঠিকানা নিয়ে পরবর্তীতে আমরা গিয়ে দেখি কোথাও এডিস মশার উৎস আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে আমরা রোগীর বাড়ির আশেপাশে বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করি এবং এ সময় রোগীসহ এলাকাবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে আসি। কারণ, মশা কোনো সীমানা মানে না। সেজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদেরই সচেতন হতে হবে।’ এডিস মশা নিধনে দুই সিটি কর্পোরেশন একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে কি না— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উত্তর ও দক্ষিণ দুটি আলাদা সিটি কর্পোরেশন এবং তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রমও আলাদা। তবে এডিস মশা নিধনে দুই সিটি কর্পোরেশন সমানভাবে কাজ করছে। আমরা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, সেগুলো আমরা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়ে দেব। এজন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমরা এডিস মশা নিধনে চিরুনি অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করছি এবং লিফলেট বিতরণ করে মানুষকে সচেতন করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নগরবাসীকে বলতে চাই, কাজ শেষে পানি যেন এক দিনের বেশি জমিয়ে না রাখা হয়। প্রতিদিনের পানি প্রতিদিন পরিষ্কার করলে এডিস মশার লার্ভা বংশবিস্তার করতে পারে না। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এছাড়া ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’ সাধারণত প্রতি ওয়ার্ডে এডিস মশা নিধনে সকালে সাতজন এবং বিকালে ছয়জন মশককর্মী কাজ করে থাকেন। তবে বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা ওয়ার্ডগুলোতে ১৩ মশককর্মী সকালে লার্ভিসাইডিং এবং ১৩ জন বিকালে এডাল্টিসাইডিং পরিচালনা করবেন।

এদিকে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এ মুহূর্তে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর এই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াতে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে। আগামী দুই মাস হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রমও চালাতে হবে। 

উল্লেখ্য, প্রতিবছর বর্ষাকালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গত বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন। চলতি বছরও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

Link copied!