Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

সংসার চালাতে হাঁসফাঁস

রেদওয়ানুল হক

রেদওয়ানুল হক

মে ২০, ২০২২, ০৬:৪৫ এএম


সংসার চালাতে হাঁসফাঁস

‘আমাদের মতো লোকের এমন কাজ মানায় না। তাই দিনে কাজ করি না। রাতে তিন ঘণ্টা করে কাজ করে ফজরের আগেই বাসায় ফিরে যাই। শক্তিতে কুলায় না তাই সপ্তাহে তিন-চারদিন করি। দৈনিক ৩৫০ টাকা করে আয় হয়। এটা দিয়ে সংসারের খরচ মেটাতে স্বামীকে সহায়তা করি।’ 

মাথায় মাটির ঝুড়ি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলছিলেন মিতু। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী শহীদ ফারুক সড়কের পার্শ্ব সড়ক জেলেপাড়া গলির সংস্কার কাজে শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। রাত তখন সাড়ে ৩টা। মধ্যবয়সি মিতুকে দেখে সাধারণ শ্রমিকের মতো মনে হয়নি এই প্রতিবেদকের। আলাপচারিতায় বেরিয়ে আসে মিতুর জীবনযুদ্ধের করুণ বাস্তবতা। 

অষ্টম শ্রেণি পাসের পর বিয়ে হয় পাশের গ্রামের মমিনুলের সাথে। মমিনুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারীর চাকরি করেন। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে মাঝারি সংসার। মাঝেমধ্যে দেবর রিফাতের পড়াশোনার খরচ বাবদ কিছু দিতে হয়। করোনার আগ পর্যন্ত মোটামুটি টেনেটুনে ভালোই চলছিল। 

বিপদে আপদে মমিনুলের বড় ভাইয়েরাও সহায়তা করত। কিন্তু করোনা মহামারি সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে। দেবরের টিউশনি নেই। বড় ভাসুররা নিজেরাই আছে সমস্যায়। অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়েছে। বাসাভাড়া বাকি পড়েছে। ছেলে-মেয়ের গৃহশিক্ষক বাদ দেয়ার পরও বাকি পড়েছে স্কুলের বেতন। সংসার পরিচালনায় কোনো হিসাবই মিলছে না। স্বামী দিনের ডিউটি শেষে মধ্যরাত পর্যন্ত হকারের কাজ করে। তবুও কুলকিনারা পাচ্ছেন না। 

তাই স্বামী-শাশুড়ির প্রবল আপত্তির মুখেও শ্রমিকের কাজ করছেন। প্রতিবেশী রাজিয়ার মাধ্যমে রাত ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের কাজ পেয়েছেন। তাই ভারী কাজের অভ্যাস না থাকলেও অনেক কষ্টে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সহকর্মীরা অবশ্য তাকে বেশ সহায়তা করছে। অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের কাজটিই তারা মিতুকে দেয়। রাজিয়া বলেন, ‘জীবনে কখনো চিন্তাও করি নাই মিতু ভাবী আমাগ লগে মাটি টানার কাজ করব। বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য গালি দেয় তাই বাধ্য হইয়া কাজে আসছে।’ 

জীবনের হিসাব না মেলা এমন লাখ লাখ রাজিয়া এখন জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এ যুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ নিত্যপণ্য। যার জোর দিন দিন বেড়েই চলেছে। দফায় দফায় বাড়ছে ভোগ্য ও নিত্য ব্যবহার্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম। ইতোমধ্যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির। 

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে অচলাবস্থার মধ্যেই আরেক দফা বৃদ্ধির গুঞ্জন শুরু হয়েছে। সব মিলে এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে জনজীবন। শুধু গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা বেসরকারি চাকরিজীবী নয় বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরও এখন হিসাব মিলছে না। ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেয়েও সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। 

স্বাস্থ্যকর্মী ফখরুল আমার সংবাদকে বলেন, বাজারে গেলেই সব হিসাব উল্টে যায়। এরপর আবার বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম বাড়লে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে। ‘এমন একটা অবস্থায় আছি, কারো কাছে হাতও পাততে পারি না।’

নিত্যপণ্যের রেকর্ড দাম বৃদ্ধির মধ্যেই পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর ভোজ্যতেল, চাল, গম, আটা, পেঁয়াজ, ডালসহ সব ধরনের ভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম আরও এক দফা বেড়েছে। এতে জনজীবন থমকে দাঁড়িয়েছে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঈদের আগে যে মসুর ডাল (ছোট দানা) ১২০ টাকা বিক্রি হয়েছে তা এখন ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় দানার মসুর ডাল কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়ে ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

পাশাপাশি প্রতিকেজি খোলা চিনি মানভেদে ৪-৬ টাকা বেড়ে ৮৪- ৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি খোলা আটা ৫-৭ টাকা বেড়ে ৪৫-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা ময়দা কেজিতে ৫-৮ টাকা বেড়ে ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলুর দাম পাঁচ টাকা বেড়ে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩৫ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতিকেজি দেশি ও আমদানি করা আদা ১০ টাকা বেড়ে ১৫০ ও ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

পাশাপাশি প্রতিকেজি দেশি রসুন ২০ টাকা বেড়ে ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়ার তালিকায় যোগ হয়েছে শুকনা মরিচও। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ২২০-২৪০ টাকা। বাজারে নতুন করে মুরগি ও গরুর গোশতের দামও বেড়েছে। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ১৮০ টাকা। 

ঈদের আগে ৭০০ টাকা কেজিদরে প্রতিকেজি গরুর গোশত বিক্রি হলেও এখন সর্বোচ্চ ৭২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ডিমের দামও বেড়েছে। প্রতি হালি (৪ পিস) ফার্মের ডিম এক সপ্তাহ আগে ৩৬ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানিভেদে প্রতিকেজি গুঁড়াদুধ ৬৫০-৬৯০ টাকা বিক্রি হলেও খুচরা বাজার ও পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৯০-৭৫০ টাকা।

এছাড়া বেড়েছে নিত্য ব্যবহার্য সব পণ্যের দামও। বাজারের সুপরিচিত একটি ব্র্যান্ডের এক কেজি ওজনের এক প্যাকেট গুঁড়া সাবানের দাম ১০ টাকা বেড়েছে। এই সাবান কিনতে কয়েকদিন আগেও লাগত ১৪০ টাকা, যা এখন ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি ১০০ গ্রাম ওজনের সুগন্ধি সাবানের দাম ছিল ৪০ টাকা, যা নতুন করে ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি ব্র্যান্ডের শ্যাম্পুর ১৮০ মিলিলিটারের বোতলের দাম ছিল ১৮০ টাকা, যা বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে। একটি ব্র্যান্ডের ৪৫ গ্রামের একটি টিউবের দাম ৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। 

বিক্রেতারা বলছেন, সাবানের দাম এখন নিয়মিত বিরতিতে বাড়ছে। কোনো পণ্যের দামই স্থিতিশীল নেই। গত বছরের শেষ দিক থেকেই একাধিকবার এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। নতুন করে বাড়ানো হয়েছে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে। 

এর ফলে বেড়েছে ক্রেতাদের দৈনন্দিন ব্যয়। যেমন- কাপড় কাচার জন্য এক কেজি গুঁড়া সাবান, থালাবাসন ধোয়ার জন্য আধা লিটার তরল সাবান, একটি সুগন্ধি সাবান, এক বোতল শ্যাম্পু ও টুথপেস্ট কিনতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫৫৭ টাকা, যা ঈদের আগের তুলনায় ৫০ টাকা বেশি। অর্থাৎ এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশ।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, সঠিক রোডম্যাপ তৈরি করে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে সিন্ডিকেট চক্র যাতে বাজার কারসাজি করতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে টিসিবি, ওএমএসসহ খোলাবাজারে সরকারি উদ্যোগে পণ্য বিক্রি স্বাভাবিক রেখে বাজার সহনীয় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।  

অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিকে আপদকালীন সময় উল্লেখ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উচিত প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা নেয়া। যেমনিভাবে করোনা এবং বিভিন্ন বন্যা ও দুর্যোগকালে বিত্তবানদের সহায়তা নেয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। চ

লমান প্রকল্পগুলোর বাইরে নতুন স্কিম চালু করে বেশি সংখ্যক মানুষকে সহায়তার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে যানবাহন মালিকসহ সেবা খাতের সাথে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে এই মুহূর্তে বেশি লাভ না করার জন্য অনুরোধ করতে হবে।

পাশাপাশি ওএমএস কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।’ এমন পরিস্থিতি বেশিদিন থাকবে না জানিয়ে অন্তত ছয় মাসের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালুর পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।

Link copied!