মিরাজ আহমেদ, মাগুরা
জুন ২৭, ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম
১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ জুন এই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মাগুরা জেলার মানুষ যেন ফিরে পেয়েছে নতুন এক আশ্বাস। অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির রাজত্বে যে জনপদের জন্য ভয় ছিল নিত্যসঙ্গী, সেখানেই আজ ফিরেছে নিরাপত্তা, শান্তি ও স্বস্তি। এসব কিছুর পেছনে অব্যক্ত কিন্তু অসামান্য ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাগুরায় নিয়োজিত সেনা সদস্যরা।
অপারেশন চালানো থেকে শুরু করে মানবিক সহায়তা প্রতিটি পদক্ষেপেই তারা হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক।
মুক্তিযোদ্ধা ও মাগুরার সচেতন সমাজের ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১-২০২৫ এ সময়ের মধ্যে সন্ত্রাস ও অস্ত্র উদ্ধারে এরূপ সাফল্য এককথায় নজিরবিহীন।
মাগুরা আর্মি ক্যাম্প কর্তৃক ৫ মাসে পরিচালিত ৬০টিরও বেশি অভিযানে যে পরিমাণ অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে, তা এক কথায় চমকে দেয়ার মতো।
উদ্ধারকৃত সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ৩টি বিদেশি পিস্তল, ১৭টি ওয়ান শুটার গান, ১টি রিভলভার, ৩টি পাইপ গান, ৩টি আধুনিক এয়ারগান, ৮টি হাতবোমা, ১২টি কার্তুজ, ৬৫টি তাজা অ্যামুনিশন, ১টি অতিরিক্ত ব্যারেল, ২টি অতিরিক্ত ম্যাগাজিন। ৩২৪টি এয়ারগান অ্যামুনিশন, ১টি পুলিশের লুট হওয়া টিয়ারশেল। এ ছাড়াও উদ্ধার করা হয়েছে— ৩১টি দা, ৩২টি রামদা, ১৩টি চাইনিজ কুড়াল, ১৭টি চাইনিজ চাপাতি, ১৫টি ছুরি, ৪১টি ঢাল, ৪৯টি সুরকি, ১টি হাতুড়ি, ১০টি স্ট্যাম্প, ১টি হকিস্টিক, ২৭টি ছিনতাইকত মোবাইল ও মেমোরি কার্ড।
অস্ত্রের পাশাপাশি মাদকবিরোধী অভিযানেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। উদ্ধারকৃত মাদকের তালিকায় রয়েছে ৬৭০ পিস ইয়াবা, ৪১৫ বোতল ফেন্সিডিল, ৩ কেজি ৬৯২ গ্রাম গাঁজা। ১০ গ্রাম হেরোইন, ৪টি মরফিন, ১ বোতল বিদেশি মদ। ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৫ টাকা নগদ, ২২৮টি সিম কার্ড, ৭৫টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, ৫টি মোটরসাইকেল, অবৈধ কাঠসহ দুটি ভ্যান।
এ ছাড়াও মাগুরায় বহুল আলোচিত শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সারা দেশে যখন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তখন সারা দেশের নেয় মাগুরাতেও আইনশৃঙ্খলা অবনতি হয়। আগুন জ্বালিয়ে মাগুরা সদর থানা ঘেরাও করে বিক্ষুপ্ত জনতা।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে খুব দ্রুত ফিরে আসে স্বাভাবিক পরিবেশ। ওই দিন লাখো জনতা সেনাবাহিনীর প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করে।
মাগুরা সেনাবাহিনী শুধু অভিযান পরিচালনাই করেনি, বরং অসংখ্য মানবিক কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করেছে। উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে—
রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা।
ঈদ উপলক্ষে প্রধান সড়কে নিরাপত্তা টহল ও চেকপোস্ট স্থাপন।
বহুল আলোচিত শিশু আসিয়া হত্যা মামলার তদন্তে সহায়তা ও অভিযানে অংশগ্রহণ।
একজন অসুস্থ প্রসূতির জন্য তাৎক্ষণিক রক্তদান ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান।
মাগুরা আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্রে চুরি ও বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি দমন, সড়ক নির্মাণ কাজে দুর্নীতি অনিয়ম দমন।
বিভিন্ন কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের প্রেষণামূলক ক্লাস এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য উৎসাহ প্রদান।
বিভিন্ন ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে অনিয়ম উদঘাটন ও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা।
আড়পাড়ায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে খাবার ও নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান।
অনিবন্ধিত প্রাইভেট ক্লিনিকে সরকারি ওষুধ বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা।
গ্রাম্য বিবাদ ও সংঘর্ষ থামাতে নানাবিধ উদ্যোগ।
এ ছাড়াও ২৪ ঘণ্টার অনলাইন হেল্প ডেস্ক চালু করে দখলদারি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে সেনাবাহিনী সদা তৎপর। সাধারণ মানুষের মুখে প্রশংসা আর সন্তুষ্টি অর্জন করেছে মাগুরা আর্মি ক্যাম্প।
গত তিন মাসের এক অনুসন্ধানে এ জেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মো. আব্দুল কাদের, ব্যবসায়ী (নেছারাবাদ বাজার) বলেন, আগে সন্ধ্যার পর আতঙ্কে দোকান বন্ধ করতাম। এখন সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল দেয়, রাতেও নির্ভয়ে ব্যবসা করি।’
শুক্রবার সাংবাদিকদের এক সাক্ষাৎকারে মাগুরা ক্যাম্প কমান্ডার মেজর শাফিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের প্রতিটি নাগরিককে নিরাপদ, সম্মানজনক পরিবেশে বাঁচার অধিকার দিতে বদ্ধপরিকর। মাগুরায় আমরা শুধু অপরাধ দমন নয়, বরং জনগণের পাশে মানবিকভাবেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।’
ইএইচ