Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

খুলছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বপ্নের দ্বার

আসাদুজ্জামান আজম

আসাদুজ্জামান আজম

মে ২৫, ২০২২, ০১:০৬ এএম


খুলছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বপ্নের দ্বার

অবশেষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে ২৫ জুন। ওইদিন সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। নাম পরিবর্তন নিয়ে একাধিক প্রস্তাব থাকলেও পদ্মা সেতু নামে নামকরণ ও উদ্বোধনের দিন হিসেবে ২৫ জুনকে নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি ২ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সূত্র মতে, গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গণভবনে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ এবং নামকরণের সংক্ষিপ্ত তালিকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় নিজের নামে পদ্মা সেতু নামকরণের প্রস্তাব ফের নাকচ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু নামেই রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। 

এর আগেও একাধিকবার নিজ নাম রাখার প্রস্তাব নাকচ করেন তিনি। গণভবন থেকে বেরিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদ্মা সেতুর দুটো সামারি (সার সংক্ষেপ) দিয়েছিলাম। একটা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সামারি, যেখানে তিনি ২৫ জুন তারিখ লিখে সই করেছেন। আরেকটি ছিল পদ্মা সেতুর নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ করার। সেটিতে তিনি সই করেননি।

তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু পদ্মা নদীর নামেই হবে। এটা আমি অন্য কারো নামে দেব না। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কারো নামেও হবে না’।

সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, যারা বেশি বিরুদ্ধে বলছে, তাদের আগে আমন্ত্রণ জানানো হবে।’ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণায় দক্ষিণাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আশার প্রতিফলন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। যার কারণে দক্ষিণাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পোস্ট করছেন অনেকেই। 

আমাদের মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই স্থানীয়রা আনন্দে মেতে উঠেছেন। হাটবাজারগুলোতে মিষ্টি বিতরণ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 

জানতে চাইলে শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম আমার সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসিক নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তো বটেই, সারাজীবন বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য দোয়া করবে এবং কৃতজ্ঞ থাকবে। গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে পদ্মা সেতু মাইলফলক হয়ে থাকবে। ’

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু সমগ্র বাংলাদেশের জন্য এটি এখন মর্যাদার সেতু। সেতুটি নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে। নানা মহলের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অদম্য সাহসিকতায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে ১৯৯৮ সালে সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রথমে বিদেশি অর্থায়নে সেতুটির নির্মাণ কাজ হওয়ার প্রস্তুতি ছিল সরকারের।  

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ১৩ দিনের মাথায় ১৯ জানুয়ারি সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়াগ প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করে। তারা ১৮ মাসের মধ্যে সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, প্রি-কোয়ালিফিকেশন ডকুমেন্ট ও মূল টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রণয়ন ও পরিচালনা করে। 

ওই সময় পদ্মা সেতুতে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। সেতু বিভাগের নিজস্ব প্রকৌশলী এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে অভিজ্ঞ কিছু প্রকৌশলী পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়। সেতুর গুরুত্ব ও ব্যাপকতার কারণে কাজ তদারকি ও পরামর্শের জন্য দেশি-বিদেশি ১১ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এক্সপার্ট প্যানেল। 

ওই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। ২০০৯ সালেই বিশ্ব ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ যায়। দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিশ্ব ব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেয়া হয় ও সচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। 

পরবর্তীতে এমন কোনো অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। অভিযোগের কারণে আটকে যায় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। ২০১২ সালের জুনে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে দেয়। তারপরও বিশ্ব ব্যাংককে ফেরাতে সরকার তাদের সব শর্ত মেনে যেতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করার বিষয়ে একেবারেই অনড় থাকে। এরপর প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদ্মা সেতু একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির উপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ। 

পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে, ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে স্বপ্নের এ সেতু। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নিজস্ব অর্থায়নে বৃহৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, জাতি হিসেবে আমরা কতটা আত্মপ্রত্যয়ী। 

সেতু বিভাগ সূত্র মতে, ২৫ জুনকে সম্ভাব্য তারিখ ধরে সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই পাড়ে বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। গঠিত উপকমিটি কাজ শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হচ্ছে। দুটি ম্যুরালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি থাকবে। 

গত ২৩ মে জাজিরা প্রান্তের সাউথ ভায়াডাক্টে কার্পেটিং সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সড়ক পথ পেয়েছে পূর্ণাঙ্গতা। মূল সেতুর পর দুই প্রান্তের ভায়াডাক্টের কার্পেটিংও শেষ হয়েছে। এখন চলছে রেলিং ও রেলিংপোস্ট এবং দুই পাড়ে অস্থায়ী সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ। পুরো সেতুজুড়েই এখন ব্ল্যাকটপ। 

আর রাতে আলো ছড়াতে দুই পাশের প্যারাপেটের নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট। ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বালানোর কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চলছে বিমানে আসা প্রথম ও দ্বিতীয় চালানের রেলিং ও রেলিংপোস্ট স্থাপন। অন্যদিকে সমুদ্র পথে আসা রেলিংয়ের বড় চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে। সেতুতে রোড মার্কিং চলছে পুরোদমে। 

সেতু প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম গত সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘মূল সেতুর ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। নদীশাসন কাজের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য সেতুর দুই প্রান্তকেই প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী মাওয়া প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এরপর তিনি জাজিরা প্রান্তের টোলপ্লাজায় আয়োজিত উদ্বোধনী কাজেও অংশ নেবেন। সেজন্য মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা উভয় প্রান্তেই নেয়া হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। জাজিরা প্রান্তের টোলপ্লাজায় উদ্বোধনী কাজ শেষ করে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সেই লক্ষ্যে সার্বিক কাজ দ্রুত শেষ করতে সেতু বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

তিনি আরও জানান, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর আগে থেকেই এই প্রকল্প নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা ধরনের আলোচনা হওয়ায় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য সেতু বিভাগ থেকে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি করা হয়েছে। বর্ণাঢ্য সেই আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভায় উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন। 

জমকালো অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সদস্য, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। এর আগে গত ১৭ মে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলে টোল হার নির্ধারণ করে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় যানবাহনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন টোল হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পদ্মা সেতু পার হতে সর্বনিম্ন টোল দিতে হবে মোটরসাইকেল আরোহীকে। 

মোটরসাইকেলের জন্য টোল নির্ধারণ হয়েছে ১০০ টাকা, কার ও জিপ ৭৫০ টাকা, পিকআপ এক হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস এক হাজার ৩০০ টাকা। ছোট বাস (৩১ আসন বা এর কম) এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাস (৩ এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা। ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ টনের অধিক থেকে ৮ টন পর্যন্ত) দুই হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৮ টনের অধিক থেকে ১১ টন পর্যন্ত) দুই হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা এবং চার এক্সেলের ট্রেইলারের টোল সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ আদেশ পদ্মা বহুমুখী সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার দিন থেকে কার্যকর হবে।

পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘যখনই যেখানে ব্রিজ নির্মাণ করে স্ট্যান্ডার্ড হলো ফেরির ১ দশমিক ৫ শতাংশ টোল (যেমন- ফেরিতে ১০০ টাকা হলে ব্রিজে ১৫০ টাকা) ধরা হয়। সেটা ধরেই করা হয়েছে। 

এরপরও সরকার যদি মনে করে এটা বেশি হয়েছে...। অনেকে পদ্মা সেতুকে বঙ্গবন্ধু সেতুর সঙ্গে তুলনা করে। বঙ্গবন্ধু সেতু হলো ৫ কিলোমিটার, আর পদ্মা সেতু হলো ৯ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার। প্রায় দ্বিগুণ। পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে ১ শতাংশ হারে সুদে সরকারকে ফেরত দিতে হবে। সুতরাং সেতু কর্তৃপক্ষকে ওই জায়গা থেকে টাকা উপার্জন করতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পৃথিবীর কোথাও এই ধরনের স্থাপনার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পয়সা না দিয়ে যাওয়ার কোনো সিস্টেম নেই। তিনি বলেন, ফিজিবিলিটি স্টাডিতে যেমন ছিল যে, ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে টাকাটা (পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়) উঠে আসবে। এখন মনে হচ্ছে ১৬-১৭ বছরের মধ্যেই টাকাটা উঠে আসবে। ওই পাড়ের যেসব কাজকর্ম এবং যেগুলো আছে সেগুলো ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আসেনি। মোংলা পোর্ট যে এত স্ট্রং হবে, পায়রা বন্দর হবে, এত শিল্পায়ন হবে— এগুলো কিন্তু আসেনি। ধারণা ছিল পদ্মা সেতু ১ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আনবে। এটা ২-এর কাছাকাছি চলে যাবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে। 

সেতু বিভাগ সূত্র মতে, পদ্মা সেতুর কারণে বদলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নতুন গতি পাবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা, স্কুল-কলেজ, পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠা পাবে কৃষি ও মৎস্য-নির্ভর শিল্পকারখানা। কর্মসংস্থান ঘটবে বেকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর। 

পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে  ফরিদপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মোংলা, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও মুন্সীগঞ্জে নতুন করে শিল্পায়ন হবে। পরোক্ষভাবে সারা দেশের মানুষই উপকৃত হবে। ঢাকা ও মোংলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় গড়ে উঠতে শুরু করেছে শিল্পাঞ্চল। ইতোমধ্যে সড়ক পথে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। 

দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ অনেক নতুন উদ্যোক্তা শিল্প-কারখানা গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। পদ্মার তীর ঘেঁষে হাতছানি দিচ্ছে নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন শহরের প্রতিচ্ছবি। ইতোমধ্যে জাজিরাপ্রান্তে ক্যান্টনমেন্ট এবং স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রিসোর্ট, হোটেল গড়ার কাজ হাতে নিয়েছেন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রিয় ভ্রমণ ও অবকাশকেন্দ্র হয়ে উঠছে পদ্মার পাড়। সেতুর অবকাঠামো তৈরি হওয়ার পর থেকেই পর্যটকদের পথচারণা বাড়ছে। পদ্মার পাড়ে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের একটি অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করার হচ্ছে ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী’। 

যার মাধ্যমে দুই জেলার কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এছাড়া ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন রকম শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার  উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কয়েকগুণ বেড়ে গেছে আশপাশের জমির দাম। কলকাতা-আগরতলা রেল যোগাযোগ আরও সহজ হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে সরকারিভাবেও নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। 

সেতুর উভয় পাশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎসাহিত করতে গ্যাস সংযোগের ব্যবস্থা, দক্ষিণে বিসিক শিল্পনগরীগুলো চালু ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমপ্রসারণসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প স্থাপনের সহায়ক নীতি গ্রহণ, মাশুল আদায়ে স্বয়ংক্রিয় ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রবাহে ফাইভার অপটিক ক্যাবল স্থাপন, মাস্টার প্ল্যানের আওতায় সেতুর উভয় পাশে উন্নয়নের ব্যবস্থা, পৃথক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, নদীর উভয় পাশে ইকোপার্ক স্থাপন করা হবে।  

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এর পরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।

Link copied!