Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২১ মে, ২০২৫,

নটরডেম কলেজে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু

রহস্য জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ দাবি

মামুনুর রশিদ, বিশেষ প্রতিনিধি

মামুনুর রশিদ, বিশেষ প্রতিনিধি

মে ২০, ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম


রহস্য জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ দাবি

রাজধানীর নটর ডেম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের দুই শিক্ষার্থী ধ্রুবব্রত দাস (১৮) ও আরাফাতের (১৮) মৃত্যুর রহস্য এখনো ঘোর অন্ধকারে। তাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। দুই পরিবারের পক্ষ থেকে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। 

আরফাতের পিতা আব্দুল্লাহ আল মামুন দৈনিক আমার সংবাদকে কান্না করতে করতে বলেন, আমার স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে। আমার দুই ছেলের মধ্যে আরাফাত বড় ছেলে। সে খুব নম্র-ভদ্র ও শান্ত। আমার সন্তান আত্মহত্যা করার কোনো কারণ নেই। মনে করলাম সে আত্মহত্যা করল কিন্তু কেন আত্মহত্যা করল। আত্মহত্যার প্ররোচনার কারণ কি আমাদের তো জানতে হবে। আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। হাতজোড় করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সরকারের প্রতি অনুরোধ আমার মানিকের মৃত্যুর কারণ আমাদের জানানো হোক।

এই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে প্রশ্নের জট তৈরি হচ্ছে। সাত দিন পার হলেও কোনো প্রশ্নের উত্তর পায়নি দুটি পরিবার। পরিবার দুটি তাদের সন্তানের মৃত্যু কেন— এর উত্তর খুঁজছেন। প্রশাসনের কাছেও আকুল আবেদন, আমাদের কেন এর উত্তর দেয়া। অকাল মৃত্যু হওয়া দুই শিক্ষার্থীর পরিবার কোনো মতেই এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।

জানা গেছে, এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় আত্মহত্যা নাকি অন্য কিছু কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহসহ শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবু তদন্তে কোনো কুলকিনারা মিলছে না। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একই কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে সহপাঠী ও অভিভাবকদের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে। একই সঙ্গে তাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নানান প্রশ্ন উঠছে। যদিও এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

গত ১২ মে ধ্রুবর মৃত্যুর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর উত্তর কমলাপুরের জসিম উদ্দিন রোডে একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে নটর ডেমের আরেক শিক্ষার্থী আরাফাতের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পরে সন্ধ্যায় অন্য রুমমেটরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রুমটি ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় দরজা ভেঙে তাকে বের করতে হয়। সহপাঠীরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে মানসিক চাপে ছিলেন আরাফাত, তবে ঘটনার প্রকৃত কারণ জানাতে পারেননি কেউ।

এ ঘটনায় নিহত আরাফাতের বাবা আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, আমি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে থাকি। সেদিন বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে তার এক রুমমেট রিমন আমাকে ফোন করে জানান, আরাফাত দরজা খুলছে না। তাকে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তখন বিষয়টি আমার কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। আমি রিমনকে বলেছি, তুমি বাড়ির ম্যানেজারের কাছে যাও। তার (ম্যানেজার) কাছে এক্সট্রা চাবি আছে, তাকে সঙ্গে নিয়ে রুম খুলো। পরে সন্ধ্যায় তারা আমাকে জানিয়েছে আরাফাত গলায় ফাঁস দিয়েছে। আমি তখন দ্রুত ঢাকায় এসে রাত ২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলের লাশ দেখতে পাই। পরে তার মরদেহ নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি ভৈরবের কালিকা প্রসাদে নিয়ে দাফন করি।

আরাফাতের আত্মহত্যার বিষয়ে মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মহায়মেনুল ইসলাম বলেন, আরাফাতের রুম ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। রুমের দরজা ভেঙে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে তার রুমমেটরা। তার হাতের লেখা কিছু চিরকুট পাওয়া গেছে। সেগুলোতে কিছুটা প্রেমঘটিত বিষয় রয়েছে। ফলে এটি আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

ছেলের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে অভিযোগ তোলেন আবদুল্লাহ-আল-মামুন। তিনি বলেন, আমার ছেলের কিছুটা শারীরিক অসুস্থতা ছিল। তার মৃত্যুর আগের দিন আমি ঢাকায় গিয়ে তাকে ডাক্তার দেখিয়েছি। পরদিন সোমবার বিকালে তার ডাক্তারের কাছে ফলোআপে যাওয়ার কথা ছিল। মামুন বলেন, সেদিন (১২ মে) আরাফাত দুপুরে কলেজ থেকে বাসায় ফেরে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। পরে বিকালে তার মা বাসায় ফেরার পর আবারও পরিবারের সবার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে আরাফাতের সঙ্গে আমাদের শেষ কথা হয়। তখন আরাফাত বলল, আমি একটু রেস্ট নিয়ে বিকালে ডাক্তারের কাছে যাবো। এরপর শুনি সে আত্মহত্যা করেছে। এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।

নানান প্রশ্ন তুলে মামুন বলেন, পুলিশ যেসব চিরকুট পেয়েছে- সেসব আমার ছেলের হাতের লেখা না। তাছাড়া আমার ছেলের রুমের দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। তার রুমমেটরা কখনও তার রুমে নক করে না। সেদিন কেন তার রুমমেটরা দরজা বন্ধ দেখে এত টেনশনে পড়েছে? এছাড়াও আরাফাত লম্বায় পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি। অথচ তার খাট থেকে ফ্যানের দূরত্ব প্রায় পৌনে পাঁচফিট। একটা মানুষ যখন আত্মহত্যা করে, গলায় ফাঁস নেয় তখন সে জীবন বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করে। তার হাত-পা অনেক নাড়াচাড়া করে। অথচ আরাফাতের খাটের সঙ্গে লাগানো কাপড় রাখার আলনার কিছু হয়নি। বিছানা, কাপড় সবকিছুই পরিপাটি ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব!


বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, যখন ছেলে মারা যায়, তখন এত কিছু ভাবিনি। ছেলের শোকে কাতর ছিলাম। এখন ছেলের মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলাতে পারছি না। আমার ছেলে কীভাবে মারা গেছে, সে কি আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে- আমরা জানতে চাই। আমরা চাই, পুলিশ যাতে আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করে বের করে।

নিহত আরাফাতের বাবা মামুন ও মা ইশরাত জাহান চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত আছেন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে আরাফাত বড় ছেলে। ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ভৈরবের কালিকা প্রসাদ।

এ দুটি ঘটনায় নটর ডেম কলেজ কর্তৃপক্ষ শোক প্রকাশ করে বলেছে, ‘দুটি মর্মান্তিক মৃত্যুর পেছনের সত্য উদঘাটনে প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছি এবং নিহতদের পরিবারের পাশে আছি।’ দুই তরুণের আকস্মিক বিদায়ে সহপাঠী-শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে শোক-স্তব্ধতা নেমে এসেছে। আর প্রশ্ন রয়ে গেছে, ধ্রুব ও আরাফাতের সাথে সত্যিই কী ঘটেছিল? রহস্যের জট খুলতে সংশ্লিষ্ট সবাই এখন অপেক্ষায়।

নিহত ধ্রুবব্রত দাসের বাবা বানি ব্রতদাস চঞ্চল পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার দুই ছেলের মধ্যে ধ্রুব বড়। ছোট ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়েন। তাদের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সদর উপজেলার মধ্যপাড়া গ্রামে। পরিবার নিয়ে ঢাকায় গোপীবাগ এলাকায় থাকেন। দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় এখনও তদন্ত চলছে জানিয়ে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবা উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনা দুটি দুর্ঘটনা বলে মনে হয়েছে। একটি আত্মহত্যা, অন্যটি ভবন থেকে পড়ে মৃত্যু। তবে এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে কিনা- তা তদন্তের পর জানা যাবে। এ দুটি ঘটনায় এখনও তদন্ত চলছে।

Link copied!