Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২০ মে, ২০২৪,

আগ্রাসী যমুনা

খোলা আকাশের নীচে বিধবা স্বর বানু, দুলু খাতুনরা

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি

আগস্ট ৮, ২০২২, ০৪:৫৩ পিএম


খোলা আকাশের নীচে বিধবা স্বর বানু, দুলু খাতুনরা

কলকল করে বয়ে চলা যমুনার ঘূর্ণি স্রোতে ধসে গেছে নদী তীর রক্ষা বাঁধ। তাতেই দুঃস্বপ্নের মত ভসভস করে তলিয়ে গেছে স্বামীহারা স্বর বানু আর বিধবা দুলু খাতুনের বসতভিটা।

স্বরবানুর স্বামী মারা গেছেন একযুগ আগে। ছেলে ও মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অন্যত্র বিয়ে করেননি আর। স্বামীর ভিটা আঁকড়ে ধরে অন্যের বাড়িতে কাজ করে এবং খেতে-খামারে কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। কঠোর পরিশ্রম আর নিজের আত্মবিশ্বাস দিয়ে জীবন যুদ্ধে অপরাজেয় এই মা দুই মেয়ে ও ছেলেকে বিয়েও দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে ছেলের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করে জীবিকার তাগিদে চলে গেছেন শহরে। স্বর বানুর যেন দুঃখের দিন শেষ হওয়ার নয়। ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করার পর স্বর বানুর উপরই নতুন করে যুক্ত হয় ৪ বছর বয়সী নাতি। এরপর হঠাৎ করে বাড়িটাও যমুনা গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে খোলা আকাশের নীচে ভাঙা টিন মাথার উপর দিয়েই কোনরকম আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি বাধের উপর।

এদিকে দুলু খাতুনেরও দুনিয়ায় কেউ নেই। একমাত্র সম্ভব বসতভিটাও নদী গর্ভে চলে যাওয়ার পর দুচোখে কেবল যমুনার স্রোতের মত টলটলে অশ্রু আর একরাশ হতাশার কুয়াশা ছাড়া কিছু নেই।

অপরদিকে ৫৪ বছর বয়সী ঈসমাইল হোসেন। উপজেলার সোনাতুনি ইউনিয়নের হাতকোড়া গ্রাম নদী গর্ভে চলে যাওয়ার পর ভিটেমাটি হাড়িয়ে একদশক আগে বাড়ি করেছিলেন যমুনার কোল ঘেঁষে। ভেবেছিলেন সরকার যেহেতু কোটি কোটি টাকা খরচ করে নদী তীর রক্ষা বাঁধ করেছেন এখন আর অন্তত বসতভিটা হারাতে হবে না। তাই তিনি শেষ বয়সে একটু নিশ্চিত জীবন যাপনের জন্য প্রায় পনেরো লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করেছিলেন পাকা ঘর। কিন্তু তারও আর দুঃখের দিন শেষ হলো না। একরাশ হতাশার মধ্যে সমস্ত স্বপ্ন ডুবিয়ে দিয়ে যখন যমুনা তীর রক্ষা বাঁধে ধস নামে তখন কেবল ঘরের কয়েকটি জানালা, দরজা আর আসবাবপত্র কোনক্রমে সরিয়ে নিয়ে নিরুপায় দেখতে হলো সাধের বসতভিটা কি করে আস্তে আস্তে তলিয়ে যায় নদী গর্ভে।

এভাবেই রূপচাঁদ মোল্লা, মো. এরশাদ মোল্লা, মজনু মোল্লা, আলী মোল্লা, আমদ আলী মোল্লা, বাতেন মোল্লাসহ অর্ধশতাধিক মানুষ কোনক্রমে ঘরের চাল খুলে নিয়ে খুঁজে ফিরছেন আশ্রয়।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত যমুনা নদীর তীর রক্ষা বাঁধে নতুন করে ধস শুরু হয় সপ্তাহ খানেক আগে। তীর রক্ষা বাঁধের সিসি ব্লক ধসে ইতোমধ্যেই মসজিদসহ ২৫টি বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক দিনেই যমুনার ঘূর্ণি স্রোতে ধসে যায় যমুনার তীর রক্ষা বাঁধ। উপজেলার গালা ইউনিয়নের বেনোটিয়া পয়েন্টে কয়েকটি স্থানে এ ধস শুরু হয়। নদী তীরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন ও মধুমালা, বিধবা দুলু খাতুন, বিধবা স্বর বানু, রূপচাঁদ মোল্লা, মো. এরশাদ মোল্লা, মজনু মোল্লা, আলী মোল্লা, আমদ আলী মোল্লা, বাতেন মোল্লা জানান, বর্ষার শুরুতেই আমরা নদীর এই অংশের আশংকাজনক অবস্থার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবগত করি। কিন্তু সময়মত তারা ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই ধস শুরু হয়। কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিমুলকান্দি জামে মসজিদ নদী গর্ভে চলে যায়।

তারপর একে একে আবুসামা, মো. সরদ আলী, আমদ হোসেন, আব্দুল বাতেন, মো. নদী হোসেন, রূপে মোল্লা, মজনু মিয়া, আলী, শিউলি খাতুনসহ অন্তত ২৫ জনের ঘরবাড়ি যমুনার পেটে চলে গেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকায় আমরা আতংকিত। ভাঙন অব্যাহত থাকায় আমরা নিজেদের ঘর অন্যত্র সরিয়ে ক্রমাগত আশ্রয় খুঁজছি। একদিকে বসতবাড়ি নেই অপরদিকে কাজ না থাকায় জীবিকা নির্বাহ করাই দুঃসহ হয়ে গেছে বলেও তারা জানান।

তারা আরও বলেন, এই ভাঙন ঠেকানো না গেলে সরকার যে নতুন করে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করেছে সেটিও নদী গর্ভে চলে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। আর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেলে হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়বে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় গালা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেনের সাথে। তিনি জানান, বাঁধ নির্মাণের সময় তীর রক্ষা বাঁধের একেবারে নিকট থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন এবং অবৈধ বালু ব্যবসায়ীরা অপরিকল্পিত ভাবে নদী থেকে বালু তোলার কারণে সিসি ব্লকের নিচ থেকে বালু ও জিও ব্যাগ সরে গিয়ে বাঁধের বিভিন্ন অংশে ধসের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনেক আগেই লিখিত ভাবে জানালেও তারা কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এর ফলেই এখন ধস সৃষ্টি হয়েছে। আর মাত্র ৪০/৫০ মিটার ভাঙলেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ধস শুরু হবে। আর সেটা হলে কি পরিমাণ ক্ষতি হবে তা অকল্পনীয়। এছাড়াও যাদের বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে তাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মাথাগোঁজার ঠাই। সেই সাথে তাদের দ্রুত প্রয়োজন ত্রাণ

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ার শাহীন কামালের সাথে। তিনি জানান, ভাঙন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমরা জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছি। আশাকরি আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবো।

ভাঙন কবলিত এলাকায় থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিরাজগঞ্জের কার্যসহকারি মো. নুরুল ইসলাম জানান, নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় হঠাৎ করেই ধস শুরু হয়। তবে আমরা ভাঙন ঠেকাতে সাথে সাথেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।

এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে জানানোর পর সাথে সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। ইতোমধ্যেই তারা জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে।

আমারসংবাদ/এসএম

Link copied!