ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Amar Sangbad

ইনস্টাগ্রাম

Amar Sangbad

এক্স

Amar Sangbad


লিংকডইন

Amar Sangbad

পিন্টারেস্ট

Amar Sangbad

গুগল নিউজ

Amar Sangbad


হোয়াটস অ্যাপ

Amar Sangbad

টেলিগ্রাম

Amar Sangbad

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Amar Sangbad


ফিড

Amar Sangbad

ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই, ২০২৫
Amar Sangbad
ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের স্মৃতি

গাছের ডালে ঝুলছিল লাশ আর লাশ

নাজমুল ইসলাম, শরণখোলা (বাগেরহাট)

নাজমুল ইসলাম, শরণখোলা (বাগেরহাট)

নভেম্বর ১৪, ২০২৩, ০৪:৫৫ পিএম

গাছের ডালে ঝুলছিল লাশ আর লাশ
সিডরের তাণ্ডবে পরিবারের ৮ সদস্যকে হারানো সেই কিশোর মোস্তফা। ছবি: আমার সংবাদ

‘মুই যদি মা-বাপ, ভাই-বুইন ছাইরা ঢাকায় চইল্যা যাই। হ্যারা মোরে কইবে, মোস্তফা তুই এতো স্বার্থপর, তুই মোগো ছাইরা চইল্যা গেলি! না স্যার মুই যামুনা। মোরে আমনেরা মাপ কইরা দেন। মুই মোর মা-বাপের কবরের ধারে পইরা থাকমু। মুই কোতাও জামু না স্যার ! এই অবদার পাড়ে বইয়া থাকমু’- কিশোর মোস্তফা

মোস্তফার বয়স তখন ১১ বছর। ১৫ নভেম্বর সিডর রাতে মা-বাবাসহ পরিবারের সবার সঙ্গে ঘরেই ছিলো মোস্তফা। ঘরটা ছিলো বলেশ্বর নদীর কোল ঘেঁষে। সিডরের তাণ্ডব শুরুর আগে টিপ্ টিপ্ বৃৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় ভয় পাচ্ছিলেন না তারা। তবে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে হঠাৎ ৩০ ফুট পানির উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস আর ২৪০ কিমি. গতিবেগের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় মুহূর্তের মধ্যেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় মোস্তফাদের বাড়ি-ঘর। প্রবল স্রোতে ঘর ও গাছ-পালার সঙ্গে ভেসে গিয়ে মোস্তফা একটি রেইন্ট্রি গাছের ডাল ধরে বেঁচে যায়। সেখানে সারারাত ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে। সকালে পূর্ব আকাশে আলোর রেখা ফুটে উঠতেই মোস্তফা দেখতে পায় চারদিকে শুধু ধ্বংসলীলা।

কারো বাড়ি-ঘরের কোন চিহ্ন নেই। অচেনা এক ধ্বংসস্তুপের মাঝে নেমে দাঁড়ায় মোস্তফা। গাছের ডালে ডালে লাশ ঝুলছে। ধানক্ষেত, জলাশয়, বেড়িবাঁধের খাদে, নদীর পাড়ে মৃতদেহের ছড়াছড়ি। কোথাও কোথাও মানুষ আর পশু-পাখি এক হয়ে ভাসছে।

মোস্তফা নিজের বাড়ি-ঘর নিজেই চিনতে পারছেনা। মা-মা, বাবা-বাবা বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে কিশোর মোস্তফা। কোথাও কোন উত্তর মিলছেনা।

চারদিকে শুধু স্বজন হারানোর আর্তচিৎকার। কেউ মায়ের লাশ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। কেউবা সন্তানের লাশ বুকে জড়িয়ে করুন সুরে বিলাপ করছে।

মোস্তফা যার কাছেই বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করছে উত্তর দিচ্ছে না কেউই। মা-বাবা, ভাই-বোনের খোঁজে হাঁটতে থাকে ক্লান্ত মোস্তফা । অবশেষে একটি ভাঙা গাছের ডালে ঝুলতে দেখে মা মর্জিনা বেগমকে। মায়ের মরদেহ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে মোস্তফা। কিছু দূর হেঁটে গিয়ে দেখে ভাঙা বেড়িবাঁধের খাদে বাবা সোবাহান মোল্লার (৫৫) মরদেহ পড়ে আছে। তার পাশে পড়ে আছে বড় বোন রাবেয়া বেগমের লাশ। কিছু দূরে ঝোপের পাশে বড় ভাই শামীমের দেহ। প্রতিবেশীদের কাছ জানতে পারে তার দাদী হামিতোন্নেছা ও বোনের ছেলে সাব্বিরের লাশ বলেশ্বর নদের পাড়ে পড়ে আছে।

কার লাশ কোথায় পড়ে আছে শুনে যেন আর লাভ নেই মোস্তফার। পরিবারের ৮টি লাশের ভার কিভাবে নিবে কিশোর মোস্তফা। রাতে ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে এমনিতেই ক্লান্ত। প্রতিবেশী স্বজনরা সেই লাশগুলো তুলে তুলে ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশে পুতে রাখে। ধর্মীয় রীতিতে দাফন করা সম্ভব হয়নি তাদের। শুধু মোস্তফার পরিবারই নয়। কাপনের কাপড়সহ দাফন জোটেনি সিডরে নিহত হওয়া শরণখোলার ৯ শতাধিক মানুষের মধ্যে প্রায় ৮শ’ মানুষের।

সিডরের পর সর্বহারা মোস্তফার শুরু হয় ভবঘুরে জীবন। পথই তার ঠিকানা। সারাদিন রাস্তা-ঘাটে রাত হলে শুকনো খরকুটোর মধ্যে শুয়ে পড়তো। কেউ সামনে খাবার তুলে দিলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। পরে দেশী- বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীরা যারা সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলার সাউথখালীতে আসতো তারা সবাই খুঁজে নিতেন গাবতলা এলাকার মা-বাবাসহ পরিবারের ৮ সদস্যকে হারানো সেই কিশোর মোস্তফাকে।

ঢাকা থেকে আগত কেউ কেউ মোস্তফার দায়িত্বভার গ্রহন করে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও তাতে রাজী হয়নি মোস্তফা।

তার ভাষায়, ‘মুই যদি মা-বাপ, ভাই-বুইন ছাইরা ঢাকায় চইল্যা যাই। হ্যারা মোরে কইবে, মোস্তফা তুই এতো স্বার্থপর, তুই মোগো ছাইরা চইল্যা গেলি! না স্যার মুই যামুনা। মোরে আমনেরা মাপ কইরা দেন। মুই মোর মা-বাপের কবরের ধারে পইরা থাকমু। মুই কোতাও জামু না স্যার ! এই অবদার পাড়ে বইয়া থাকমু।’

সেই সময়ের কিশোর মোস্তফাকে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বেড়িবাঁধের পাড়ে একটি কুড়ে ঘর তৈরি করে বিয়ে দিয়ে দেয় প্রতিবেশীরা।

শুরু হয় কিশোর মোস্তফার দাম্পত্য জীবন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় মোস্তফা ছোট একটি নৌকা আর কিছু জাল সাহায্য পায়। নদীতে মাছ ধরে যা পায় তাই দিয়ে চলে সংসার। পরবর্তীতে সৌদি সরকারের সহায়তায় একটি ছোট্ট টিনের ঘর পায়। নগদ অর্থ সহায়তাও পায় কিছু। এর মধ্যে মোস্তফার ঘরে জন্ম নেয় রাব্বী নামে এক ছেলে সন্তান। পরে এলমা নামে আরও এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।

মোস্তফার স্ত্রী শাহানাজ বেগম জানান, নদীর পাড়ে থাকতে ভয় করে। ঝড়-বইন্যা চলতেই থাহে। তাই নদীর পাড়ের ঘর ভাইঙ্গা গ্রামের মইধ্যে আইছি।

মোস্তফা জানান, ‘সিডরের পরে যে সাহায্য সহযোগীতা পাইছি তাই দিয়া একটু বাড়ির জমি কিনছি। একটা ঘর উডাইছি। এহন আর ক্যাশপাতি নাই। নদীতে মাছ পাইনা। তাই এহন মানসের কাম- কাইজ কইরা খাই। অনেক সময় কাম পাই অনেক সময় পাইনা। সব মিলাইয়া ভালো নাই।’

এআরএস

Link copied!