Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

ঘর-সম্পদ হারিয়ে ধনীরাও ছিন্নমূল

আবদুর রহিম ও মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত

আবদুর রহিম ও মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত

জুন ২৩, ২০২২, ১২:৪৯ এএম


ঘর-সম্পদ হারিয়ে ধনীরাও ছিন্নমূল
  • সিলেটের রাস্তা পুনর্নির্মাণ ও মেরামত করতে তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন
  • সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার কারণ হাওরে ৪৭৫ কোটি টাকার অপরিকল্পিত রাস্তা
  • ঘরে ঘরে খাবার সংকট, অন্তঃসত্ত্বা নারীরা সংকটে, অপরিবর্তিত বন্যা পরিস্থিতি
  • পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠান বন্যাকবলিত সিলেটবাসীর সাথে রসিকতা —দাবি বিএনপির

সিলেট ও সুনামগঞ্জের পথে পথে হাজারো দুঃখগাথা গল্প। কয়েকদিন আগেও যারা ধনী ছিলেন আজ তারা ছিন্নমূলের তালিকায়। কোটি টাকার বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। নড়বড়ে হয়ে গেছে ঘর। পানি সরলেও সেই বাড়িতে থাকা ঝুঁকি। এমন বাড়ির সংখ্যা হাজার হাজার। আবার যাদের আধাপাকা বা টিন, ছন, বাঁশ ও মাটির ঘর ছিল এমন প্রায় অর্ধলাখ ঘর পানির নিচে। 

এখনো প্রায় অনেক এলাকায় ঘরের চালার ওপর দিয়ে বন্যার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। উঁচু এলাকার গাছও পানির নিচে ডুবে গেছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ভেঙে পানির সাথে ভেসে গেছে। পানি কিংবা বন্যা কমলেও সম্পদের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না অনেকে। এখন  জীবন বাঁচিয়ে কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে, আবার কেউবা সড়ক-মহাসড়কের পাশে খুপরি ঘর তৈরি করে কিংবা ট্রাকে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এ যেন বাস্তুচ্যুতির এক লোমহর্ষক চিত্র। কোথাও প্রাণচাঞ্চল্য নেই। বানভাসি এলাকায় অনাহারি লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। লাখো মানুষ এখনো উদ্ধারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। 

এছাড়া ক্যাম্পে আশ্রয় বা সড়কে অবস্থান নেয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীরা  সংকটে রয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা এখনো আশা জাগাচ্ছে না। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষ ছুটে যাচ্ছে। এতে কিছুটা সহায়তা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় খাবারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। কিছু উঁচু জায়গায় ভ্রাম্যমাণ খাবার থাকলেও সবার পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চারদিকে পানি আর পানির কারণে এখনো সিলেট ও সুনামগঞ্জ বিপর্যস্ত নগরী। যেখানে এক টুকরো শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই মাথা গোঁজার জন্য দৌড়ানো হচ্ছে। সড়কের শুকনো জায়গার ওপর মানুষ তাঁবু ও ডেরা টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এখনো পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। সিলেটের কয়েকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারা ও সারি নদীর দুটি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার নিচে থাকলেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

এদিকে গতকাল জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ তোলা হয় সিলেট, সুনামগঞ্জে বন্যার কারণ হাওরের বুকে ৪৭৫ কোটি টাকার অপরিকল্পিত রাস্তা যা একক ব্যক্তির সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়। পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠান বন্যাকবলিত সিলেটের সাথে রসিকতা বলেও দাবি তোলা হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। 

বন্যার সার্বিক পরিস্থিতিতে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, দুই জেলার বিস্তীর্ণ গ্রাম এখনো পানির ওপর ভাসছে। বিশেষ করে পানি নেই এমন এক ইঞ্চি জায়গাও এখন মিলবে না সুনামগঞ্জ জেলায়। বেশ কিছু সড়কে ছোট ছোট ছাউনি দিয়ে গরু-ছাগল রাখছে দুর্গত মানুষ। বাসার ছাদের উপরও গরু রাখতে দেখা গেছে। ঘরের নিচতলা-দোতলা পানির নিচে। ছাদে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে গরুর পাশাপাশি মানুষও থাকছে! 

এদিকে, কালও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। তবে কাল সকাল থেকে সিলেটে বৃষ্টি হয়নি। দুপুর থেকে অনেক কাঙ্ক্ষিত রোদের দেখাও মিলেছে। রোদের দেখা মিললেও মানুষের মুখে হাসি ফোটেনি একটুও। জেলায় প্রায় নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যায় তছনছ রাস্তাঘাট : বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১১ হাজার ৬৭০ কিলোমিটার রাস্তা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। অনেক স্থানে রাস্তা কেটে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তার লেশমাত্র নেই। পানির তোড়ে ছোট, দুর্বল ও পুরোনো কালভার্ট-ব্রিজ উপড়ে গেছে। যেসব স্থানে পানি কমতে শুরু করেছে, সেখানে পানির নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে এবড়োখেবড়ো রাস্তা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই। ভাঙা রাস্তাঘাটের কারণে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের মানুষের যাতায়াতে চরম ভোগান্তি হবে। এসব রাস্তা পুনর্নির্মাণ ও মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করতে ব্যয় হবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। সময়ও লাগবে বেশ। 

সিলেটের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী গোপাল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, এলজিইডির রাস্তাগুলো মেরামত করতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। আর নতুন করে তৈরি করতে খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ লাখ। কিন্তু বন্যার যে ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে অনেক স্থানেই নতুন করে রাস্তা তৈরি করতে হবে। 

নিখোঁজের তিন দিন পর ভেসে উঠল লাশ : জৈন্তাপুরে নিখোঁজের তিন দিনের মাথায় নদীতে ভেসে উঠেল নিখোঁজ যুবকের লাশ। গতকাল বেলা ১১টায় স্থানীয় নৌকা শ্রমিকরা সারী নদীর কামরাঙ্গী স্কুলঘাট এলাকায় একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখে বিষয়টি স্থানীয়দের জানান। তার নাম বিলাল। সে চারিকাট ইউপির দক্ষিণ কামরাঙ্গীখেল গ্রামের মুহিব মিয়ার ছেলে। এলাকাবাসী জানান, গত রোববার রাত  থেকে দক্ষিণ কামরাঙ্গীখেল গ্রামের বিলাল আহমদ (৪০) নিখোঁজ হন।

রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা : এদিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় বন্যার পানি বাড়ছে। তাতে এখন গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে পানি বাড়লে বা স্রোত বাড়লে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রাখা যাবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। 

এখনো অপরিবর্তিত বন্যা পরিস্থিতি : সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পাঁচটি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে লোভা, সারি ও ধোলাই নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমেছে। অতিবৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যা পরিস্থিতি গত বুধবার থেকে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এতে নগরসহ আশপাশের বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেন। এদিকে সিলেটের সবচেয়ে দূরবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের পৌরসভা ছাড়া ৯টি ইউনিয়নের সব প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত এসব স্থানে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান পানি ছিল। জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফয়সাল বলেন, ‘তিন দিন ধরেই অল্প অল্প করে পানি বাড়ছে। গতকাল সারা দিন রোদ থাকলেও ঢলের কারণে পানি বেড়েছে।’ সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এখনো আমাদের বিদ্যুৎ, যোগাযোগ বন্ধ। শহরের একটি অংশের কিছু স্থানে সামান্য বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সব জায়গায় চালু করতে সময় লাগবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ জেলা প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা ৪৫০ আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ স্যালাইন দিচ্ছি।’

তলিয়ে গেছে গবাদিপশুর ৭১০ খামার : চলমান বন্যায় প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পানিতে সিলেট জেলায় হাঁস-মুরগিসহ তিন হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা গেছে। আর ডুবে গেছে গবাদিপশুর ৭১০টি খামার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি কমলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে জেলায় এখন পর্যন্ত তিন হাজার ১৮৯টি গবাদিপশু মারা গেছে। আর জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট জেলায় ৭১০টি খামার ডুবে গেছে। 

পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠান বন্যাকবলিত সিলেটেবাসীর সঙ্গে রসিকতা —দাবি বিএনপির : বৃহত্তর সিলেটে ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে আওয়ামী সরকারের অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দায়ী করছে সিলেট জেলা বিএনপি। পাশাপাশি বন্যার ভয়াবহতা অস্বীকার করে বন্যার্তদের সাথে সরকারদলীয় নেতাদের উপহাস করার অভিযোগও করছেন জেলা বিএনপির নেতারা। এ ছাড়া চলমান দুর্যোগের সময় পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সরকারের আড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করাকেও বন্যাকবলিত সিলেটের সাথে রসিকতার নামান্তর বলে উল্লেখ করছেন তারা। গতকাল দুপুরে সিলেট নগরীর একটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সাংবাদিকদের সামনে এসব বক্তব্য তুলে ধরেন জেলা বিএনপি নেতারা।

Link copied!