Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

সুনামগঞ্জের ঘরে ঘরে কষ্টের গল্প

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট 

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট 

জুন ২৬, ২০২২, ০১:৪৯ এএম


সুনামগঞ্জের ঘরে ঘরে কষ্টের গল্প

চারিদিকে অথৈ জল। মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একটি গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই নিম্ন আয়ের। ভয়াল বন্যায় তছনছ করে দিয়েছে পুরো গ্রাম। পানির তোড়ে নুয়ে পড়েছে বাঁশ-টিনের ঘরবাড়ি। আধাপাঁকা বাড়িগুলোর অবস্থাও নড়বড়ে, দেখে বোঝার উপায় নেই কিছু দিন আগেও এখানে মানুষের বসতি ছিল। শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার মালিকান্দি গ্রাম ঘুরে এমন করুণ দৃশ্য দেখা গেছে।

ভিটে ছাড়া কিছুই নেই জমির আলীর : গ্রামের পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব জমির আলী জানান,‘তার ঘরে বুক সমান পানি ছিল। দুদিন আগে পানি নেমেছে। তবে সর্বনাশা বানের জল সব নিয়ে গেছে। ঘরের ভিটে ছাড়া এখন আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই।’ 

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এখন ঘর মেরামত করব কী করে? আসবাবপত্র কেনারই বা টাকা পাবো কোথায়?’
বানের জলে বিয়ের খাটও নষ্ট হয়ে গেছে : গ্রামের বাসিন্দা বানেছা বেগম (৫০)। ছেলে ছেলের বউ আর দুই নাতি নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার তার। 

তিনি জানান, স্বামী মারা গেছেন দু’বছর আগে। দিনমজুর ছেলের আয়-রোজগারে কোনোমতে চলছিল টানাপড়েনের সংসার। বানের জল তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ভেঙে পড়েছে বাঁশ-টিনের ঘর। বন্যার পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বানেছা বেগম বলেন, ১৭ জুন রাতে তার উঠানে পানি উঠে। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় পুরো ঘর। পানির তোড়ে হেলে পড়ে ঘরের বেড়া। প্রাণে বাঁচতে রাতেই আশ্রায় নেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলায়। ছয় দিন পর গত বৃহস্পতিবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন। এখন ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

বানেছা জানান, ‘এখন ঘর থেকে পানি নেমেছে ঠিকই, তবে ভোগান্তি বাড়ছে। পুরো ঘরে কাদা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দরকারি জিনিসপত্র ও কাপড়-চোপড়। আসবাবপত্র যা-ই ছিল পানিতে ভিজে সব নষ্ট হয়ে গেছে। ছেলের বিয়ের একখানা খাট ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেছে।’ এদিকে এখন বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসনের জন্য ফান্ড গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্গতদের সহায়তায় কাজ করা স্বেচ্ছাসেবীরা। 

এ বিষয়ে সিলেটের নাট্যকর্মী রুবেল আহমদ কুয়াশা বলেন, ‘আপাতত শুকনো খাবার বিতরণের চাইতে বন্যার্তদের পুনর্বাসনের জন্য ফান্ড গঠন করা দরকার। তিনি বলেন, মানুষ তার আপৎকালীন সঞ্চয় আর ত্রাণ দিয়ে বন্যা চলাকালীন সংকট পার করে দিতে পারবে। কিন্তু তার মূল বিপদ পানি নামার পরেই দেখা দেবে। কারণ টিনের চাল, ঘরের বেড়া পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরের আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে। পানি নামার পর এগুলো মেরামতে বিপদে পড়বে তারা।’

সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘এখনো বেশির ভাগ জায়গায় পানি রয়ে গেছে। এখন আমরা ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছি। পানি পুরো নেমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।’ গত ১৫ জুন থেকে সিলেটে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। প্লাবিত হয় জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা। এখনো বেশির ভাগ এলাকা জলমগ্ন। বন্যায় গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ৪৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি : ৯ দিন ভোগান্তির পর সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নগরের কিছু এলাকা ছাড়া সব এলাকায় পানি কমেছে। তবে জেলায় ধীরগতিতে বন্যার পানি নামছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পানি খুব ধীরগতিতে নামছে। অনেক স্থানে আবার পানি স্থির আছে। ফলে বানভাসি মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। গতকাল সকালে নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটে জমে থাকা বন্যার ময়লা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নগরের প্রধান সড়কগুলোর থেকে পানি নেমে গেছে। তবে কিছু সড়কে এখনো পানি রয়েছে। তবে সব কটি সড়কেই যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার পানি বাড়ায় গতকাল পর্যন্ত জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ, দক্ষিণ সুরমায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, সিলেটে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। তবে ধীরগতিতে পানি নামছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে পানি আরও কমে যাবে।

আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ : এদিকে পানি কমতে শুরু করায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে।  জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ তারিখ পর্যন্ত সিলেট জেলার ১৩ উপজেলা ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনে ৬১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই লাখ ৫২ হাজার ৮৭৮ জন আশ্রয় নেন। তবে গতকাল দুপুর পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন ৯১ হাজার ৬২৩ জন। সে হিসেবে, প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছেন। সিলেট সদর উপজেলার নলকট এলাকার রহিমা বেগম বলেন, ‘পাঁচ দিন বাদাঘাট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। পানি কমায় শুক্রবার বিকেলে বাড়ি ফিরেছি।’

বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ : জেলা প্রশাসনের হিসাবে, চলমান বন্যায় জেলায় ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪৪ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আর ২২ হাজার ১৫০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসল নষ্ট হয়েছে ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর। এর বাইরে প্রাণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া  বন্যায় পানিতে ডুবে এবং রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১টি গরু, ছয়টি মহিষ, ২১টি ছাগল ও ১৬টি ভেড়া।

Link copied!