Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪,

লাভ দেখাচ্ছে লোকসানি ব্যাংক (পর্ব-দুই)

রেদওয়ানুল হক

অক্টোবর ৬, ২০২২, ০১:০১ এএম


লাভ দেখাচ্ছে লোকসানি ব্যাংক (পর্ব-দুই)

সমস্যায় থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) আয় করেছে। বাস্তবে তাদের আয় হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নিয়মের ফাঁকফোকর গলিয়ে এসব ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদনে আয় দেখিয়েছে। একই কারণে বেড়েছে সম্পদের পরিমাণও। এতে বাইরে থেকে ব্যাংকগুলোর অবস্থা মোটাতাজা দেখা গেলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। কৌশলগত আয় দেখানোয় পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের তালিকায় থাকছে। ফলে শেয়ারের কারসাজি করে সুবিধা নিচ্ছে একটি পক্ষ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভিশনে ছাড় দেয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপনে (রাইট অফ) ছাড় দেয়ায় ব্যাংকের মুনাফায় এই উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া অনাদায়ী সুদ আয় খাতে যোগ করার ফলে হিসাবে বড় গরমিল তৈরি হচ্ছে। এতে সাময়িক সুবিধা মিললেও দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিতে পড়ছে ব্যাংক।

জানা গেছে, কয়েকটি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাড় নিয়েছে। এছাড়া আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পরপরই ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এসব ছাড় দেয়ার কারণে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার পরও নিয়মিত করে রেখেছে। আবার আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ দেখিয়েছে আয় খাতে। সুযোগ পেয়ে অনেকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি। এতে প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন হলেও মুনাফা বেড়ে গেছে কিছু কিছু ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সাল শেষে দেশের ১৪টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। বরং মূলধন ঘাটতি ঢাকতে নিয়েছে ডেফারেল নামক বিশেষ সুবিধা। সুযোগ নেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড। ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। এতে মূলধন ঘাটতি থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও ব্যাংকটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, প্রভিশন সংরক্ষণে এক বছর সময় নিয়েছে ব্যাংকটি। বছরজুড়ে ধাপে ধাপে এই বকেয়া প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের মানভেদে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। কোনো কারণে এটি রাখতে ব্যর্থ হলে মূলধন থেকে এ ঘাটতি সমন্বয় করার কথা। এতে ব্যাংকের মূলধন কমে যাওয়ার পাশাপশি পুঁজিবাজারে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ নেই। এই দুই সমস্যা সমাধানে ডেফারেল নামক অস্ত্র ব্যবহার করছে সাউথইস্ট ব্যাংক। এতে কাগজে কলমে সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে হুমকির সম্মুখীন হবে বেসরকারি এ ব্যাংকটি।

সাউথইস্ট ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১১৮ কোটি টাকা। যেটি রাখার জন্য ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছে ব্যাংকটি।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষমতা ব্যাংগুলোর হাতে দেয়ার পাশাপাশি বেশকিছু সুবিধা দিয়েছে। নতুন সুবিধা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে পাঁচ থেকে আট বছরে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেয়া হতো।

তবে গত ৪ আগস্ট এক নির্দেশনা জারি করে খেলাপি ঋণে ছাড় কমায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিন জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুনঃতফসিলের পর আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। মন্দ মানে শ্রেণিকৃত ঋণ তৃতীয় ও চতুর্থবার পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে প্রকৃত আদায় ছাড়া সংরক্ষিত প্রভিশন ব্যাংকের আয় খাতে নেয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা আসার আগেই চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংকগুলো।

এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে জুন প্রান্তিকে আগের বছরের সমপরিমাণ লাভ করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে দুই টাকা ৫৬ পয়সা। মুনাফায় পরিবর্তন না এলেও ব্যাংকটির সম্পদমূল্য গত বছরের তুলনায় কমেছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ২৬ টাকা ৮৮ পয়সা, যা গত বছর ছিল ২৭ টাকা ৯৭ পয়সা। নতুন নিয়ম অনুযায়ী সুবিধা উঠে যাওয়ায় ব্যাংকটির লাভ থেকে লোকসানের দিকে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ডেফারেল সুবিধা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়বে বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির।

বিভিন্ন ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণে বিশেষ সুবিধা নেয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা দিয়ে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে বাস্তবে এসব ব্যাংক লোকসানে থাকে। নিয়ম মেনে প্রভিশন রাখলে এরা কোনো লভ্যাংশই দিতে পারবে না। এতে বঞ্চিত হবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য খেলাপি ঋণ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় একটা সময় সুবিধা দেয়া বন্ধ করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

ডেফারেল সুবিধার সুযোগ নিয়ে লাভ দেখানোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের থেকে ব্যাংকটির প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন লিখিত উত্তরে আমার সংবাদকে জানান, ‘বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রকৃত তথ্য আড়াল করার ইচ্ছা থাকলে সাউথইস্ট ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট ১১ ও ২১-এ ওই তথ্যের উল্লেখ থাকত না। এছাড়া ডেফারেল সুবিধা নেয়ার পরও ওই বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ব্যাংকের শেয়ার প্রতি আয় দাঁড়ায় ১.৪৪ টাকা, যার ফলে ওই বছর ৮ শতাংশ নগদ এবং ৪ শতাংশ বোনাসসহ মোট ১২ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করা সম্ভব হয়। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আনুপাতিক হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট প্রভিশন তৃতীয় প্রান্তিকে সংরক্ষণ করা হবে। অর্থাৎ ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের পরে সাউথইস্ট ব্যাংকের কোনো ডেফারেল সুবিধা থাকবে না।’

এমডির এমন বক্তব্য পুরো প্রক্রিয়ার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ বাস্তবে ডেফারেল সুবিধার কারণেই ব্যাংকটি লাভ দেখাতে পেরেছিল এবং বিনিয়োগকারীদের লভাংশ দেয়ার জন্যই সুযোগটি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে অনাদায়ী সুদ আয় খাত থেকে বাদ দিলে পরবর্তী প্রান্তিকে লোকসানে পড়া বা লাভ কমে যাওয়ার শঙ্কায় আছে ব্যাংকটি।

Link copied!