Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

আধুনিক ও সাশ্রয়ী রেলব্যবস্থা রেখে যেতে চাই

মুছা মল্লিক

অক্টোবর ১৩, ২০২২, ০১:৫৬ এএম


আধুনিক ও সাশ্রয়ী রেলব্যবস্থা রেখে যেতে চাই

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত রেল খাতের সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। পদ্মা সেতু রেলসংযোগ,  ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ এবং বঙ্গবন্ধু রেল সংযোগ সেতুসহ দেশের রেল খাতের অজস্র উন্নয়নের সাক্ষী তিনি। সম্প্রতি আমার সংবাদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে দেশের রেল খাতের অগ্রগতি, সংকট-সম্ভাবনা ও সামনের পরিকল্পনার বিচিত্র দিক উন্মোচন করেছেন প্রতিথযশা এই আইনজীবী-মন্ত্রী। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক ও আলমগীর হুসাইন

আমার সংবাদ : রেলওয়ের উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেল খাতে কেমন পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন। 
নূরুল ইসলাম সুজন : এসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে। আমাদের বর্তমান যে রেলব্যবস্থা, তা মিটারগেজ ও ব্রডগেজ আকারে। একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে,  অবিভক্ত ভারতে আমাদের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল মূলত কলকাতাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ঢাকা আমাদের প্রাদেশিক পরিষদের রাজধানীতে রূপ নেয়। কিন্তু তখন ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় পদ্মা ও যমুনা নদী। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অবিভক্ত রেল যোগাযোগ ও ইন্টারসেকশন পয়েন্ট ছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সব রেলব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রেলসংযোগ ব্যবহার করত। ফলে সংগত কারণেই রেলের ব্যাপকসংখ্যক ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হয়ে যায়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তিস্তা ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ তার মধ্য অন্যতম। সে সময় অনেক রেললাইনও উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে রেলকেন্দ্রিক বহু যুদ্ধও হয়েছিল। কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান আমলে রেলে বিহারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল বেশি। তখন তাদের অনেকেই মারা গেছেন, যুদ্ধে দেশত্যাগও করেছেন। অনেকেই আবার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাথে দেশের রেল খাতও বিধ্বস্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান অনেক রেল ও সড়কপথ সংস্কার করেছেন। কিন্তু তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা যোগাযোগব্যবস্থায় যে নীতি গ্রহণ করেছিল, সেখানে রেলকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি রেলে কোনো বিনিয়োগও করা হয়নি। ফলে দেশের সম্ভাবনাময় রেল খাত ধীরে ধীরে আবারও সংকটের মুখে পড়ে যায়। এ সময় রেলের অনেক অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও লাইনকে সরিয়ে সেখানে সড়কপথ স্থাপন করা হয়েছিল। দীর্ঘদিনেও খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত এত গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রবন্দর থাকা সত্ত্বেও সে পর্যন্ত রেলকে সম্প্রসারিত করা হয়নি। এদিকে চট্টগ্রামে দোহাজারী পর্যন্ত রেলসংযোগ থাকলেও কক্সবাজার অবধি সম্প্রসারিত হয়নি। অর্থাৎ, যা বিদ্যমান ছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে আমাদের প্রায় চার থেকে ৫০০ রেলস্টেশন ছিল; কিন্তু এখন পর্যন্ত ১১০টি রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে আছে। এর  পেছনে লোকবল সংকট ও রেল সংকট অন্যতম। এর মাঝে ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। ফলে রেলের ঘাটতি ও সংকট  আরও বাড়তে থাকে। এসব ঘাটতি পূরণ করতে বর্তমান সরকার রেল খাতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে আমরা খুলনা থেকে মোংলা রেলপথ সম্প্রসারিত করেছি। মিটারগেজ  লাইনগুলোকে ব্রডগেজে রূপান্তর করছি। এছাড়া প্রতিটি জেলার সাথে রেল সম্প্রসারিত করার কাজ চলমান রয়েছে। আমাদের সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলোর সাথে রেলের  সংযোগ সম্প্রসারিত করছি।

অপরদিকে ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যে রেল যোগাযোগ ছিল, ধীরে ধীরে সে সংযোগও সচল করার কাজ করছি। বর্তমানে পদ্মা সেতুর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে রেল সংযোগও দেয়া হচ্ছে। এদিকে যমুনা সেতুর সঙ্গেও রেল সংযোগ দেয়া হয়েছে। যদিও চাহিদার ভিত্তিতে যমুনার ওপর নতুন করে ডুয়েল লাইন বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন

নির্মাণ করা হচ্ছে। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর অবধি ডাবল লাইনও হচ্ছে। আবার টঙ্গী থেকে চট্টগ্রাম অবধি ব্রডগেজ লাইন হচ্ছে। আখাউড়া থেকে লাকসাম অবধিও ব্রডগেজ লাইন তৈরি হচ্ছে। এমনিভাবে আখাউড়া থেকে সিলেট অবধি ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। এভাবেই দেশের সিঙ্গেল লাইনগুলো ডাবল লাইনে রূপ দিয়ে অধিকতর সেবা প্রদানের কাজ চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। নতুন লোকোমটিভ কিনেছি, প্যাসেঞ্জার কোচ কিনেছি, পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত ট্রেন ক্রয় করছি, সমুদ্রবন্দরের সুবিধার কথা মাথায় রেখে কন্টেইনার কিনেছি। আমরা আশা করছি প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে শেষ হলে দেশের রেল খাতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে।

আমার সংবাদ : বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হলেও রেলে উন্নতির ছাপ খুব একটা লাগেনি। এর পেছনে কোনো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কি?

নূরুল ইসলাম সুজন : নতুন একটি রেললাইন করতে তার রুট নির্ধারণ, ভূমি অধিগ্রহণ অনেকটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে রুট নির্ধারণে বেশ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। একইসাথে দেশের বিভিন্ন জায়গায় উঁচু-নিচু থাকায় আরেক বিপাকে পড়তে হয়। অনেক জায়গায় মাটি দিয়ে অনেক উঁচু করে এরপর সংযোগস্থল তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের নিজস্ব পাথরের রিসোর্স নেই, বালু নেই; এমনকি লোহাও নেই। সবকিছু বাইরে থেকে আনতে হয়। এর আগে আমাদের ভাবতে হবে একটি লম্বা সময় আমাদের দেশ খাবার নিয়েই চিন্তিত ছিল। উন্নয়নের কথা ভাবার অবকাশ ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ যেখানে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে উন্নয়নের পথে পা বাড়ানো বড় এক চ্যালেঞ্জ ছিল। একটি দেশকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সে দেশের ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগব্যবস্থা হলো পূর্বশর্ত। যে কারণে আমরা দেখি যে দেশের রেলব্যবস্থা যত উন্নত, সে দেশও ততই উন্নত। তবে আশার কথা, অনেক সংকট থাকলেও দেশের রেল খাত এখন সম্ভাবনাময় খাতে রূপ নিচ্ছে। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সঠিক পরিকল্পনা এ যাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

আমার সংবাদ : বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান ট্র্যাকে হাইস্পিড ট্রেন পরিচালনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি প্রস্তাব দিয়েছিল স্পেন। এ কাজটি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে...

নূরুল ইসলাম সুজন : সম্প্রতি রাশিয়া ও তুরস্ক দেশের রেল খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য, জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্সের সাথেও কথা হয়েছে। তাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সেসব দেশেও সফর করা হয়েছে। হাইস্পিড ট্রেনের ক্ষেত্রে ট্যালকো তাদের নতুন প্রযুক্তি। অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তিতে বর্তমান ট্র্যাকে যে ট্রেন ৬০ কিমি গতিবেগে চলে, নতুন এ প্রযুক্তিতে একই ট্র্যাকের ওপর তা ৮০ থেকে ১০০ কিমি গতিবেগে চলতে সক্ষম। এ প্রযুক্তি সরবরাহ নিয়ে তারা প্রস্তাব দিয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের একটি টিমও এসেছে। আমরা এর মাঝে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অবধি একটি সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছি। এছাড়া ঢাকা থেকে পঞ্চগড় রুটে ডুয়েলগেজেও আরেকটি ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়েছে। কিন্তু এখনো তার ফলাফল পাওয়া যায়নি। এটা শেষ হলে ট্যালকো নিয়ে আমাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

আমার সংবাদ : ২০১১ সালে রেল মন্ত্রণালয় চালু হওয়ার পর থেকে সেবার মান কিছুটা বাড়লেও রেলে লোকসানের পাল্লা ভারীই রয়ে গেছে। এর কারণ কি? 

নূরুল ইসলাম সুজন : সবাই লোকসান পোষাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু আমরা বাড়াইনি। সব গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করলেও রেলের ভাড়া কিন্তু একই রকম আছে। আর মাঝে আবার করোনার কারণে আমরা প্যাসেঞ্জার পরিবহন করতে পারিনি। এছাড়া পণ্য পরিবহনও সীমিত হয়েছে। লোকসানের এটিও একটি কারণ। তবে রেলে যেখানে ৬০০ টাকা ভাড়া, সেখানে বাসের বাড়া দুই হাজার টাকা। পার্বতীপুর থেকে রংপুর অবধি বাসের ভাড়া ৯০ টাকার বিপরীতে ট্রেনের ভাড়া মাত্র ২০ টাকা। রেল সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মানুষের সক্ষমতার কথা মাথায় রেখেছে। সুতরাং জনগণের স্বার্থে রেলকে একটি সেবাধর্মী ও সাশ্রয়ী যোগাযোগব্যবস্থায় রূপ দিতেই রেলে লাভের খাতা খোলা সম্ভব হয়নি।

আমার সংবাদ : আগামী প্রজন্মের জন্য কেমন রেলব্যবস্থা রেখে যেতে চান... 
নূরুল ইসলাম সুজন : অবশ্যই আধুনিক, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ একটি রেলব্যবস্থা রেখে যেতে চাই— যা বিশ্বের উন্নত সব দেশের সাথে তাল মিলিয়ে টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

আমার সংবাদ : এত ব্যস্ততার মাঝেও সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 
নূরুল ইসলাম সুজন : আপনাদেরও ধন্যবাদ। দৈনিক  আমার সংবাদের জন্য শুভকামনা রইল।

Link copied!